শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : নিজে হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা, বলতাম আমি না থাকলে কি করবি বোকা? ঠোট ফুলিয়ে কাঁদত খোকা আমার কথা শুনে, খোকা বোধহয় আর কাঁদেনা নেই বুঝি আর মনে। ছোট্ট বেলায় স্বপ্ন দেখে উঠত খোকা কেঁদে, দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে। দু’হাত আজো খোঁজে ভুলে যায় যে একদম, আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম। এখানে মিলে গেছে ওপার বাংলার জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানের কথাগুলো।

জীবনের পালাবদল দেখতে দেখতে শেষ বয়সে এসে কোন দুঃখ-ই যেন দুঃখ না ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া গ্রামের বৃদ্ধাশ্রম ও পূণর্বাসন কেন্দ্রে থাকা মায়েদের। কেবল আক্ষেপ, জীবনের শেষ অধ্যায়টা কাটাতে পারছেন না সাধ্য অনুযায়ী যত্নে গড়ে তোলা সন্তানদের সাথে। তাই এখন নিজেদের খেয়াল নিজেরাই রাখার চেষ্টা করেন এই কেন্দ্রে ২০ জন মা। জীবনের নানা পর্যায়, সন্তানদের স্মৃতিচারণা, আবেগময় সময়গুলো ভাগাভাগি করেন একজন আরেকজনের সঙ্গে।

বৃদ্ধাশ্রমটিতে থাকা সত্তর বছর বয়সী রোকেয়া বেগম। স্বামী আব্দুর রাজ্জাক মারা গেছেন ১৬ বছর আগে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকতেন নিজের বাড়িতেই। মেয়ে পছন্দ করে ছেলেকে বিয়েও দিয়েছিলেন তিনি। তবে বিয়ের পর বেশিদিন একসঙ্গে থাকতে পারেননি রোকেয়া বেগম। তাকে ফেলে রেখে চলে গেছেন ছেলে ও পুত্রবধু। জীবন সায়াহ্নে শেফালীর আশ্রয় এখন বৃদ্ধাশ্রমে। পরিবারের ভরসার স্থল ছেড়ে রোকেয়ার আশ্রয় নিতে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ হলেও সন্তানের স্নেহ-ভালোবাসা ভ’লতে পারছেন না তিনি। সন্তান ছেড়ে গেলেও সব সময় তাদের মঙ্গল কামনা করেন অবহেলিত এই মা।

রোকেয়া বেগম বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় তাদের বাড়ি রয়েছে। সেখানে ছেলে ও পুত্রবধুকে নিয়ে একসঙ্গেই বসবাস করতেন। একদিন হঠাৎ ছেলে বলেন, এই বাড়িতে থাকতে তাঁর ভালো লাগছে না। কয়েকদিন পারে জানতে পারি, ছেলে তাঁর শ্বশুরবাড়ি যশোরে বসবাস করতে চায়। পরে ছেলে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে যশোরে চলে যায়। আমার সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়। বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবৎ ছিলাম। সেসময় অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। তখন স্থানীয় এক ব্যক্তির সহযোগিতায় হরিণাকুন্ডুর এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোকেয়া বেগম বলেন, ‘মায়ের সাথে থাকলে ওর কি এমন অসুবিধা হতো আমি বুঝতে পারিনা। তারপরেও আমি দোয়া করি ওরা সুখে থাকুক।’

শুরু থেকেই ওই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন ফরিদপুরের রাশিদা বেগম নামে এক নারী। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেরা তাকে আর বাড়িতে থাকতে দেয়নি। পরে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর ভাইয়েরাও তাকে ভরণপোষণ দেয়নি। কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে তিনিও আশ্রয় নিয়েছেন জোড়াপুকুরিয়ার এই বৃদ্ধাশ্রমে।

রাশিদা বলেন, ‘অনেক দিন ধরে এখানে থাকছি। খাওয়া-দাওয়ার কোনো অসুবিধা হয় না। অবসরে কাথা সেলাইসহ গল্প-গুজব করে দিন চলে যায়। মাঝে মাঝে ছেলেদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়লেও তো তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনা। তাই এখানে যারা আছে তাদের আপন করে নিয়েছি।’

শুধু রোকেয়া বেগম বা রাশিদা বেগম-ই না, তাদের মতো আরও অন্তত ২০ জন মায়ের জায়গা হয়েছে হরিণাকুন্ডুর এই বৃদ্ধাশ্রমে।

বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় ইসমত আরা জানান, ‘২০০৬ সালে ছেলে ও তাঁর স্ত্রী’র অত্যাচার সইতে না পেরে প্রতিবেশী এক নারী বিষপান করেছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ওই নারী বেঁচে গেলেও তাঁর বাড়িতে জায়গা দেয়নি সন্তানেরা। অসহায় ওই নারীকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন ইসমাত আরা। এরপর তিনি বৃদ্ধাশ্রম তৈরির পরিকল্পনা করেন। তারপর ২০০৯ সালে ৩ শতক জমিতে বৃদ্ধাশ্রমটি চালু করেন।’

ইসমত আরা বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমে এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে সন্তাদের কাছে আশ্রয় না পাওয়া ২১ জন মায়ের। নিজের সব সুখ বিলিয়ে দিয়ে সন্তানের মঙ্গল নিশ্চিত করতেন এই মায়েরা। সন্তানেরা সেই মায়েদেরই জীবন থেকে মুছে ফেলেছেন। অথচ সন্তানদের মঙ্গল কামনায় দিন-রাত প্রার্থণা করেন এখানকার মায়েরা।’

ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘ওই বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনেছি। একদিন সময় করে গিয়ে ওখানকার মায়েদের গল্প শুনবো।

তিনি আরো বলেন, ‘মা-বাবারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকুক এটা কাম্য নয়। এ নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।’

(এসআই/এসপি/নভেম্বর ২৬, ২০২৪)