আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে কেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এতো চক্রান্ত? মূল কারণ এই যে, বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নীতি ও সমর্থনের তোয়াক্কা না করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের প্রভাব ও শোষণের বিরোধিতা করেছেন। মার্কিন নীতিবিরোধী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। অপরদিকে একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল ও তাঁকে হত্যা না করতে পারার পরাজয়ের গ্লানিতে মার্কিন প্রশাসন ছিল আচ্ছন্ন। 

অন্যদিকে ভারত-সোভিয়েত হুমকির মুখে তার জগতবিখ্যাত সপ্তম নৌবহর হাত-পা গুটিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে তার শক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী জনতা, এমনকি তার মিত্রদের মনে একটা সন্দেহ সৃষ্টি হতে থাকে। এসব নানান কারণে সে স্বাধীন বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রতিহিংসার অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে। তাঁকে ধ্বংস ও উৎখাত করার উন্মত্ত চক্রান্ত ও পৈশাচিক ষড়যন্ত্রে তাই মার্কিন প্রশাসন আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। চুয়াত্তর সালের খাদ্যসংকটকে সে তার চক্রান্তের নিপুণতায় দুর্ভিক্ষে রূপান্তরিত করার যাবতীয় উদ্যোগ ও আয়োজন সম্পন্ন করে মানবতার সকল বৈশিষ্ট্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে। এ-কাজে সে এদেশীয় তার সমর্থকদের প্রলুব্ধ করে। এ-বিষয়ে পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে ।

স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণা ও বিচারবুদ্ধি অনুসারে দেশ পরিচালনায় ব্রত হলেন। কোনো পরাশক্তির প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করলেন না। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর আজীবন লালিত মৌলনীতি গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ যা বিগত সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই আদর্শ চতুষ্ঠয়কে জাতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে দিলেন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ নয়াউপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের সরাসরি বিরোধিতা করে জোটনিরপেক্ষ তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন। দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক নীতিতে একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করলেন। শোষণের প্রধানতম উপায় যেমন ভারি শিল্পকলকারখানা, ব্যাঙ্ক, বীমা, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বৈদেশিক বাণিজ্যকে জাতীয়করণ করে জনগণের মালিকানার ন্যস্ত করলেন। অবাধ ব্যক্তিমালিকানাকে সঙ্কুচিত করলেন। এমনকি ভূমিব্যবস্থায় একটি বৈপ্লবিক সংস্কার ঘটালেন।

বঙ্গবন্ধুর এসব বৈপ্লবিক কর্মসূচির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্ট নীতির গন্ধ আবিষ্কার করলো। তারা ভাবলো যে, তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট শিবিরে চলে গেছেন। তারা এটাও ভাবলো যে, বিশেষত: তৃতীয় বিশ্বে মুজিবের যে জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে তাতে করে তাঁর হাতেই-না সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ নয়াউপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের কবর রচিত হয়। জোটনিরপেক্ষ ও কমিউনিস্ট শিবির একত্রিত হয়েই-না পৃথিবীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে! কোনো শিবিরে অবস্থান না নিয়ে ইতোমধ্যে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিননীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তিনি ভিয়েতনাম ও পিএলওকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, ইসরাইলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন! অতএব ঠেকাও মুজিবকে। এসব কারণেই তারা বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লেগে গেল, যার ফলশ্রুতিতে চুয়াত্তর সালে সৃষ্টি করা হলো কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। পঁচাত্তর সালের হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড।

বাংলাদেশে চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষ ও পঁচাত্তর সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মনে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার উদয় হয়। তাহলো, এ দু'টি বিষয়ে ভারত-সোভিয়েত বিশেষ করে শক্তিশালী প্রতিবেশী এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের ভূমিকা কী ছিল? ঐ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ভারতের কি কিছুই করার ছিল না? শোনা যায়, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পূর্বে ভারত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে বার বার সাবধান করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও সরকারের সংস্থাপন সচিব এটিএম সৈয়দ হোসেন একদা আমাকে (লেখক) বলেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে এভাবে বলেছিলেন : Something terrible is going to happen in Bangladesh! বঙ্গবন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সতর্ক বাণীকে নাকি হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, না না, মিসেস গান্ধী! কোনো বাঙালি আমার বিরুদ্ধে মারাত্মক কিছু করতে পারে না!

তৎকালীন বিরাজমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ সাবধান বাণী উচ্চারণ করেই কি ভারত তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন? বিষয়টি নিয়ে চিরকাল বাঙালি ও বিশ্বসচেতনমহলে প্রশ্নের রেশ থেকেই যাবে।

বঙ্গবন্ধু সেদিন সারা পৃথিবী চষে খাদ্য সংগ্রহ করে এনে দুর্ভিক্ষপীড়িত দুর্গত নিরন্ন মানুষের মুখে তুলে দিতে যথাযথ প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। সারাদেশে খুলেছিলেন হাজার হাজার লোঙ্গরখানা, চালু করেছিলেন জরুরি পল্লী রেশন ব্যবস্থা। সাড়ে আটকোটি মানুষের পিতা-বন্ধু ও অভিভাবক হিশেবে তাদের জন্য যা কিছু করার সবই তিনি করেছিলেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে অল্প কিছুদিনের ভেতর দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমগুলো তাদের প্রভূদের ইংগীততে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রচার করেছিল যে, বাংলাদেশের পঞ্চাশ লক্ষ থেকে এক কোটি লোক এ দুর্ভিক্ষে মারা যাবে। এ-ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েই চক্রান্তকারীরা ঐ ছক এঁকেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের সে-দূরভিসন্ধি তাঁর নিপুণ ব্যবস্থাপনায় নস্যাত্ করে দেন মাত্র দু'মাসের মধ্যে। তবুও প্রাণ হারান সাতাশ হাজার মানুষ!

সতেরোশো সাতান্ন সালের তেইশ জুন বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার পতনের পর বৃটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ও দেশীয় মিরজাফরচক্র যেভাবে তাদের নিয়োজিত ভাড়াটে লেখক ও ঐতিহাসিকদের দিয়ে আষাড়ে গল্পের মতো তথাকথিত 'অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডের' কাহিনী ফেঁদে স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক যুবক নবাবের কপালে কলঙ্কের কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, তার সহযোগী শক্তি ও তাদের এদেশীয় সেবাদাস-দোসররা উনিশশো চুয়াত্তর সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুর নির্মল চরিত্রের ওপর কলঙ্কের কালিমা লেপন করার প্রয়াস চালায়। এক্ষেত্রেও তাদের ভাড়াটে লেখক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের কর্মকাণ্ড আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ড ও চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ ষড়যন্ত্র যেন একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

(চলবে---)

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।