কারাবন্দি ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছেন মা, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে স্বামীর মুক্তি চাচ্ছেন স্ত্রী
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : ‘আমার একমাত্র সন্তান কাবুলের বয়স যখন দেড় বছর তখন ওর বাবা মারা যায়। এরপর মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে ওকে বড় করে তুলেছি। দু’ বছর আগে কাবুলকে বিয়ে করিয়েছি। আমার পুত্রবধু এখন ৯ মাসের অন্তসত্ত্বা। আমি ও আমারপুত্রবধু কেয়াকে দেখার মতো কাবুলছাড়া কেউ নেই। স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা শওকত হোসেন দিদার হত্যা মামলায় কাবুল এখন জেলে আছে। আমরা এখনকিভাবে বাঁচবো’।
এভাবেই কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার টুটাপাড় গ্রামের মৃত হানিফ শেখের স্ত্রী শেফালী বেগম (৬০)।
একমাত্র সন্তান কাবুল কারাগারে থাকায় তার ছবি বুকে নিয়ে কেঁদে কেটে খেয়ে না খেয়ে বৃদ্ধা শেফালী বেগমের এখন দিন কাটছে। সন্তানের চিন্তায় তিনি এখন পাগল প্রায়।
অন্যদিকে শেফালী বেগমের পুত্রবধূ কাবুলের স্ত্রী কেয়া বেগম এখন ৯ মাসের অন্তসত্ত্বা। এসময় স্বামী কারাগারে থাকায় অন্তসত্ত্বা এই নারী তার অনাগত সন্তানের আগমনের চিন্তায় দিন পার করছেন। সন্তানভূমিষ্ঠের সময় কে তারপাশে থাকবে?
জানা গেছে, টুটাপাড়া গ্রামের মৃত হানিফ শেখের ছেলে কাবুল শেখ এক সময় নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এরপর সে ছাত্ররাজনীতিবাদ দিয়ে বিভিন্নএনজিও থেকে ঋন নিয়ে স্থানীয়কুশলাবাজারেএকটি মোবাইল ফ্ল্যাক্সিলোড ও ফটোকপির দোকান দেয়। এই দোকানের আয় থেকে বৃদ্ধ মা, অন্তসত্ত¡া স্ত্রীকে নিয়ে কাবুলের সংসার চলতো।
গত ২১ অক্টোবর বিকালে দোকানবন্ধ করে অসুস্থঅন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে দেখারজন্য বাড়ির পথে রওনা হলে কুশলা বাজারের পাশ থেকে কোটালীপাড়া থানা পুলিশ কাবুলকে গ্রেফতার করেন।
ওই দিন রাতেই স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা দিদার হত্যা মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়েকাবুলকে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
কাবুলের স্ত্রী কেয়া খানম বলেন, আমার বয়স যখন দুই বছর তখন বাবা মারা যায়। অনেক কষ্টে মা আমাকে বড় করেন। মা অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি টিউশনি করে সংসার চালাতাম। বিয়ের পর মা আমার সাথে শ্বশুর বাড়িতে থাকেন। স্বামীর সামান্য আয়ে আমাদের সংসার চলতো। হঠাৎকরে আমার স্বামীকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার স্বামী গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোনাপাড়ায় সংঘটিত এ হত্যাকান্ড সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে এ ঘটনায় জড়িত থাকলে গা ঢাকা দিত। এলাকায় থেকে ব্যবসা করত না। আমি আমার নিরপরাধ স্বামীর মুক্তি চাই।
তিনি আরোবলেন, আমি এখন ৯ মাসের অন্তসত্ত¡া। আগামী ১০ ডিসেম্বর আমার ডেলিভারী ডেট। ঘরে খাবার নেই। আশপাশের মানুষজন আমাদের কিছু কিছু খাবার দিচ্ছে। এভাবে আর কতদিন চলবো ? আমার সন্তান ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার আগে আমি আমার স্বামীর মুক্তি চাই। তা নাহলে বৃদ্ধ মা, শ্বাশুড়ি ও গর্ভের সন্তান নিয়ে আত্মহত্যাকরা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
প্রতিবেশি কৃষক মোস্তফা মোড়ল বলেন, কাবুল একজননিরীহ ছেলে। সে কখনোই কারো কোনক্ষতি করেনি। তাকে একটি হত্যা মামলায় জড়িয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কারাগারে থাকায় কাবুলের অন্তসত্ত্বা স্ত্রী, বৃদ্ধমা ও শ্বাশুড়ি এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এদের বাচাঁতে হলে কাবুলের মুক্তি পাওয়া প্রয়োজন।
কুশলা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরুল হোসেন বলেন, কাবুল কুশলা বাজারের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋন নিয়ে ব্যবসা করে আসছে। বর্তমানে জেলে থাকায় কিস্তির টাকা ও দোকান ভাড়ার জন্য পাওনাদাররা কাবুলের মায়ের কাছে ধরনা দিচ্ছে । যেখানে কাবুলের পরিবার খেতেই পারছেনা সেখানে ওরা কিস্তিরটাকা ও দোকান ভাড়া পরিশোধ করবে কিভাবে?
কাবুলেরআইনজীবী এ্যাডভোকেট এমএম নাসির আহমেদ বলেন, আগামী ২৮ নভেম্বর কাবুলের মামলার জামিনের শুনানী রয়েছে। আশাকরি এদিন আদালতের কাছে কাবুল সুবিচারপাবে।
কোটালীপাড়া থানার অফিসার ইন চার্জ আবুল কালাম আজাদ জানান, আমরা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা কাবুল শেখকে গত ২১ নভেম্বর আটক করে গোপালগঞ্জ সদর থানায় পাঠাই। সদর থানা পুলিশ কাবুলকে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা দিদার হত্যা মামলায় আটক দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
উল্লেখ্যঃ গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এসএমজিলানী তার বাবা-মায়ের কবর জিয়ারতের জন্য গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী গ্রামে যাচ্চিলেন। তার গাড়ি বহর গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোনাপাড়া পৌছালে স্থানেআওয়ামী লীগ ও সহযোগিসংগঠনের নেতাকর্মীরা তার গাড়ি হামলা করে। এতে এমএম জিলানী সহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়। ভাংচুর করা হয় ১০টি গাড়ি। স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদক শওকতআলী দিদারকে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়। এ ঘটনায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর শওকতআলী দিদারের স্ত্রী রাবেয়া রহমান বাদী হয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানায় ১১৭ জনের নাম উল্লেখ ও ১হাজার ৫ শ’ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
(এমএস/এএস/নভেম্বর ২৫, ২০২৪)