পর্ব: ৬
বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর শাসনামলের ইতিহাস
আবীর আহাদ
বাংলাদেশের এই দুর্বলতম সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার কথা স্মরণ করে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মার্কিন সাহায্য গ্রহণ ও তার পক্ষে অবস্থান নেয়ার অর্থই হলো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অবসান। কিন্তু চির স্বাধীনচেতা বঙ্গবন্ধুকে সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে বশ করতে পারে, পৃথিবীতে এমন শক্তির অভ্যুদয় ঘটেনি। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বন্ধক রেখে সাহায্য ও বন্ধুত্ব নয়। স্বয়ং হেনরি কিসিঞ্জার চুয়াত্তর সালে বাংলাদেশ সফরের সময় এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এমন অস্বীকৃতিতে মার্কিন সরকার ক্ষুব্ধ হন।
উনিশশো চুয়াত্তর সালে এ অবস্থার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। ঐ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মার্কিন সরকারের প্রতি ইংগীত দিয়ে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন : 'পৃথিবী আজ দু'ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে ।' এমন স্পষ্ট ঘোষণা ছাড়াও তিনি ঐ সম্মেলনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কার্যকলাপ, তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে তার খবরদারি, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় নিন্দাজ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ নয়াউপনিবেশবাদ, ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে যারাই নীতি ও অবস্থান গ্রহণ করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা-সিআইএ ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং তাদের উৎখাতের জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের আশ্রয় নিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধুর চোখের সামনে তখন ছিল চিলির জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক নেতা সালভাদোর আলেন্দের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি।
বঙ্গবন্ধুর এরূপ তেজদৃপ্ত ভাষণ শেষে কিউবার রাষ্ট্রপতি ড: ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত বিষয়ে তাঁকে হুঁশিয়ার করে দেন। ক্যাস্ট্রো একান্ত আলোচনায় বলেছিলেন : বঙ্গবন্ধু, আপনি আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে যত্নবান হোন। এখন যে আপনিই হলেন সিআইএর এক নম্বর টার্গেট। আমার পেছনে তারা কতশতবার প্রচেষ্টা চালিয়ে তারা ব্যর্থ হয়েছে, আমার দেশের মানুষ ও সরকারি যন্ত্র তাই সদাসতর্ক, আমাকে ওরা কিছুই করতে পারবে না। আপনার জাতির ইতিহাস আপনি ভালো জানেন। শুনেছি ও-দেশে ঘরে ঘরে বিশ্বাসঘাতক! আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে দিয়ে পরাজিত প্রশাসন নিয়ে দেশ চালাচ্ছেন, এখানেই আমার ভয়! আপনার নিরাপত্তা নিয়ে সত্যিই আমি উদ্বিগ্ন, বন্ধু!' এক ঘরোয়া পরিবেশে একদা বঙ্গবন্ধু নিজেই ক্যাস্ট্রো সাথে তাঁর কথোপকথনের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে আমারও (লেখক) থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল।
উনিশশো চুয়াত্তর সালে দেশের মানুষের জীবনমরণের বিবেকী তাড়নায় বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছুটে যান। দেশে তখন খাদ্য সংকট। এ অবস্থায় তিনি সম্মানের কথা ভুলে গেলেন। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোরাল ফোর্ডের সাথে দেখা করে সাড়ে সাতকোটি মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরে সাহায্যের আবেদন জানান। ফোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে রিচার্ড নিক্সনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অফিসে টেলিফোনে আঁড়িপাতার অসভ্য আচরণের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল বিরোধিতার বন্যা বয়ে গেলে তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জোরাল ফোর্ড তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। নিক্সন -কিসিঞ্জার তথা সাম্রাজ্যবাদী নীতির ধারক-বাহক রিপাবলিকান দলের ফোর্ড মহাশয় তাঁর পূর্বসূরির অনুসৃত নীতির আলোকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
যে বঙ্গবন্ধুকে মার্কিনীরা তাদের দেশে নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও সফলকাম হননি, সেই তিনি যখন স্বয়ং তাদের দেশে হাজির হলেন, দেশের মানুষের জন্য সাহায্য চাইলেন, তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেন। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সাগরজলে ফেলে দেয়, পুড়িয়ে ফেলে বা সাহায্যপ্রার্থীদের দান করে, সেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের দুরাবস্থার কথা জেনেও নিরব হয়ে রইল। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্ববরেণ্য নেতার ব্যক্তিগত আবেদন তারা প্রত্যাখ্যান করে বসলো। তাদের সাফ কথা, নগদ মূল্য পরিশোধ ছাড়া খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। অথচ তারা ভালো করেই জানে যে, তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের কোষাগার শূন্য। খাদ্যের অভাবে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।
আসল কথা হলো, তারা ভেবেছিল, এভাবে প্রত্যাখ্যান করলে বাধ্য হয়েই মুজিব তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, তিনি তাদের সেবাদাস হবেন। মার্কিন কর্তাদের হিসেবে ভুল ছিল। তারা বুঝতেই পারেনি যে, বঙ্গবন্ধু অন্য ধাঁচে গড়া বীরপুরুষ। অত:পর তিনি নগদ অর্থে খাদ্য ক্রয়ের প্রস্তাব দেন। তিনি নগদমূল্যে তাৎক্ষণিকভাবে চাল ক্রয়ের চুক্তি করলেন। তারপরও মার্কিনীদের খাদ্য সরবরাহ নিয়ে নানান তালবাহানা, কালক্ষেপন, কেন কিউবাতে বাংলাদেশ পাটের বস্তা সরবরাহ করলো? মূলত : সেদিন ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তাঁর কতিপয় ব্যক্তিগত বন্ধু বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপরও আরেক বাহানা, খাদ্য প্রেরণের জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না!
ওদিকে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে খাদ্যবাহী জাহাজ প্রেরণ করলেও সেই জাহাজ হঠাত্ আটলান্টিক সাগরে নোঙর ফেলে, উত্তর আসে, জাহাজের ইঞ্জিন নষ্ট! কারণ মার্কিনীরা ততোদিনে জেনে গেছে যে, খাদ্য প্রেরণ যতোই বিলম্ব হবে, মৃতের সংখ্যা ততোই বেড়ে যাবে। মুজিবের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেশবাসীকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা যাবে। তিনি জনসমর্থন হারাবেন। এভাবেই তাঁকে উৎখাত করা যাবে। তাই তো আমরা দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু আমলের পাইপলাইনের খাদ্যশস্য তাঁর হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথেই তরতর করে বাংলাদেশে এসে গেল। এসে গেল চৈনিক সৌদি ও পাকিস্তানের সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা!
বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র মার্কিনীদের ওপর নির্ভর করে বসে রইলেন না। সারা বিশ্বের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা, জাপানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা থেকেও আমদানি চুক্তি ও অনুদানের মাধ্যমে খাদ্যশস্যের মজুত গড়ে তুললেন। সরকারি খাদ্যগুদামে ছয়/সাত লক্ষ টন চাল-গমের মজুত গড়ে উঠলো। এই খাদ্যগুদাম যাদের অধীনে, এবার সাম্রাজ্যবাদীরা সেই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে গোপন যোগাযোগ গড়ে তুললো। এ-বিষয়ে আগেই যৎকিঞ্চিত আলোকপাত করা হয়েছে।
অতিকষ্টে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে নতুন ফসল ফলানোর যে স্বনির্ভর বিপ্লব বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন তাতে পঁচাত্তর সালে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে সারাদেশে বিপুল ফসল উৎপাদন হলো। অপরদিকে চুয়াত্তরের চুক্তির আওতায় সেই খাদ্যশস্য দেশে আসতে শুরু করলো। খাদ্যগুদাম ভরে উঠলো। মানুষের মনে দুর্ভিক্ষের ক্ষতচিহ্ন থাকলেও তারা একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে লাগলো। কিন্তু স্বস্তি ফিরে এলেও জনমনে একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো চক্রান্তকারীদের কারসাজিতে যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথেই মোশতাক-জিয়া সামরিকচক্র ঐ পাকিস্তান চীন সৌদি ও মার্কিন খাদ্যশস্য ও দেশীয় গুদামজাতকৃত খাদ্রশস্য একযোগে বাজারে ছেড়ে দেয়। তাদের সহযোগী মজুতদাররাও এগিয়ে এলো। এগিয়ে এলো তাদের চোরাকারবারি বন্ধুরাও। এই প্রথমবারের মতো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাও সহযোগী ক্ষমতাসীনদের সমর্থনে কিছুদিন মজুতদারি ও চোরাচালানি স্থগিত রাখে! ফলশ্রুতিতে খাদ্যদ্রব্যের বাজার রাতারাতি অস্বাভাবিকভাবে নেমে গেল। ভাবখানা এই যে, শেখ মুজিবের মৃত্যুই এ -আশীর্বাদ বয়ে এনেছে! অথচ তাঁর মৃত্যুর বহু আগেই কিন্তু সার্বিক বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিক স্তরে নেমে এসেছিল। দুর্ভিক্ষ ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নাটেরগুরুরা এভাবেই তাঁর নির্মম হত্যাযজ্ঞ জায়েজ করার হীনপন্থা গ্রহণ করে। (চলবে--)
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।