প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সমাজের অবহেলিত জেলে পরিবারের মেধাবী বকুল দাস লেখা-পড়া শেষ করে ভাল উদ্যেক্তা হতে চায়। উদ্যেক্তা হতে সে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নে ব্যতিক্রম কৌশল অবলম্বন করে শিশু-কিশোরদের নিয়ে সভা-সেমিনার করে এলাকার লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বকুল দাস সমাজের মারাত্মক ব্যধি বাল্য বিয়ে বন্ধে কাজ করছেন। পাশাপাশি সে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়েও কাজ করে যাচ্ছেন। তার এই উদ্যোগকে এলাকাবাসী গ্রহন করে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।  

উপজেলার চাকিরপশার ইউনিয়নের রতিরাম কমলো ঝাঁ মাঝিপাড়া গ্রামের জেলে পরিবারের বুদারু দাসের ছেলে কিশোর বকুল দাস(১৬)। অন্যের জায়গায় মাছ ধরে কেনা-বেচা করে তাদের কোন রকমে সংসার চলে। লেখা-পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে ও বিক্রি করতে যায় বকুল। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বকুল সবার বড়। ৫ জন মিলে তাদের সংসার। মা গৃহিনী। বাবা বুদারু দাস জেলে। মাছ ধরাই তাদের পেশা। মাছ ধরতে পারলে পেটে ভাত যায়, না পেলে হয়তো সেদিন উপোস করেই তাদের থাকতে হয়। বকুল দাস ফুলখাঁর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। সমাজের নিম্ন বর্ণের ছেলে হওয়ায় এবং অভাবী পরিবারের হওয়ায় বিদ্যালয়েও বন্ধু-বান্ধবরা তাকে তেমন ভালভাবে মেনে নেয় না। অভাবী সংসারে তিন ভাই-বোনের লেখা পড়া চালানো বাবা বুদারুর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই এক সময় অভাবের তাড়নায় বকুলের লেখা-পড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। এসময় ২০২২ সালের শেষের দিকে আরডিআরএস বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়িত চাইল্ড, নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের সমীক্ষা চলে ওই এলাকায়। সংস্থার নিয়মানুযায়ী বকুল দাসকে অন্তর্ভূক্ত করে সংস্থাটি। এর পর ইয়ুথ অর্গানাইজেশনের ইয়ূথ চ্যাম্পিয়ন হয় বকুল দাস। সিএনবি প্রকল্প থেকে সে ৪ দিনের প্রশিক্ষন-বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কিশোরদের জেন্ডার ও জীবনদক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষন পায়।

সদস্য হওয়ার কারণে সে এলাকায় ৪০ জন সদস্যের পৃথক ২টি দল গঠন করে তাদের ১৯টি সেশনে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালায় এলাকায়। এখন তাদের গ্রামে এর সবাই এ বিষয়ে সচেতন, অপরদেরও সে নিয়মিত সচেতন করছে। সে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭, সংগঠনের উন্নয়নের প্রশিক্ষণ (উন্নয়ন নীতি, টেকসই পরিকল্পনা, এবং যুব জড়িত পরিকল্পনা), ইউনিয়নগুলিতে যুব নেতাদের জ্ঞান বিকাশের উপর সংলাপ অধিবেশনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এছাড়া সে অপারেশন পদ্ধতি, পরিকল্পনা এবং বাজেট পদ্ধতি, চাইল্ড, নট ব্রাইড প্রজেক্ট(সিএনবি) এর অধীনে আরডিআরএস বাংলাদেশ থেকে জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। সে একটি যুব সংগঠনের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে। সে বাল্যবিবাহের পরিণতি সম্পর্কেও জানেন এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে এই জীবন দক্ষতা কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় তাও জানেন। সে তার প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের সাথে বাল্য বিবাহের খারাপ প্রভাব নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। সে বাল্যবিবাহের কুফল, যুব সংগঠনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করা, স্থানীয় ক্লাব, সরকারী কর্মকর্তা ও সিভিল সার্ভিস সংস্থার সাথে নেটওয়ার্কিং, কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতাামূলক কর্মসূচি, রক্তদান কর্মসূচী (বন্ধু রক্তদান), বিতর্কপ্রতিযোগিতা এবং একটি বিতর্কপ্রতিযোগিতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।

প্রশিক্ষক, ফুটবল খেলোয়াড়, তাৎক্ষণিক বক্তা, কোভিড-১৯-এর সময় দরিদ্রপরিবারগুলিকে সহায়তা, বিনামূল্যে মাস্ক, কোভিড-১৯-এর সময় স্যানিটাইজার বিতরণ, অসহায় সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করা, শিশু-কিশোরদের দল গড়ে তোলা এবং আলোচনা সেশন প্রদান, ছন্দ কবিতা, শিশু সুরক্ষা নীতি বিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি করে যাচ্ছেন। তাকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকতে হয়। স্থানীয় সরকার সমাজে তার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। বকুলদাস লেখা-পড়া শেষ করে ভাল উদ্যেক্তা হওয়ার কথা ব্যক্ত করেন।

এ বিষয়ে ফুলখাঁর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক দিনেশ চন্দ্র কার্জ্জী বলেন, বকুল দাস আমাদের বিদ্যালয়ের মেধাবী মুখ। লেখা-পড়ার বাইরেও মানুষকে বুঝানোর জন্য তার অনেক কৌশল রয়েছে। ভবিষ্যতে সে ভাল কিছু করতে পারবে।

এ ব্যাপারে চাইল্ড, নট ব্রাইড(সিএনবি) প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বলেন, প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি রয়েছে। কিন্তু কমিটির মনিটরিং কার্যক্রম না থাকায় বাল্য বিয়ের প্রতিরোধে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। তাই মনিটরিং জরুরী।

এ বিষয়ে চাকিরপশার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম বলেন, বকুল দাস মেধাবী ছাত্র। তার বাবা একজন জেলে। কিন্তু বকুল দাসের ভিতরে অনেক প্রতিভা। সে প্রতিভা কাজে লাগালে ভবিষ্যতে তাকে চাকুরী খুঁজতে হবে না।

(পিএস/এসপি/নভেম্বর ২২, ২০২৪)