অবৈধ দখলবাজরা গিলে খাচ্ছে কানাইপুর বাজারের ফুটপাত, রাস্তা, ড্রেন ও সরকারি জমি
রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর বাজার আঞ্চলিকভাবে ঐতিহ্যবাহী একটি বড় বাজার। ফরিদপুরের শিল্প নগরী হিসেবে পরিচিত ও শিল্প কলকারখানা বিস্তৃত এই এলাকাটিতে স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত পিয়াজ, রসুন, হলুদ, ধান, গম, ডাল,পাট, কাঁচা সবজি ইত্যাদি নানা ধরণের কৃষিজাত পণ্য পাইকারি ও খুচরা কেনাবেচার জন্য এটি একটি প্রাচীন, অতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত বাজার। বাজারটিতে প্রবেশে মূলত দুইটি রাস্তা বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি করিম জুট মিলের পাশে সিনেমা হলপট্টি টু হোগলাকান্দি রোড, আরেকটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের কানাইপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন, যা কানাইপুর বাজারে প্রবেশের প্রধান রাস্তা বা বাজার রোড হিসেবেও পরিচিত।
বাজারটির প্রধান ফটকে প্রবেশের আগে দুই পাশে, তার থেকে একটু এগিয়ে পাট হাটার বামের রাস্তার দুই পাশ, আরেকটু এগিয়ে ডান পাশ অবৈধভাবে রাস্তার উপর দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছে অনেকেই। এছাড়া বাজারে ঢোকার প্রধান সড়ক হতে মাছ বাজারের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত রাস্তাটির দুই পাশের প্রায় পুরোটাই অবৈধ দখলদারদের দখলে। ওই রাস্তার দুই পাশের দোকানগুলোর মধ্যে কিছু ভ্রাম্যমাণ দোকান হিসেবে শুধু হাটের দিনে বসে, কিছু অফ টাইমে বিকেলে বসে এবং কিছু দোকান আবার অস্থায়ী কাঠামোতে স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বাজারের রাস্তা, ফুটপাত এমনকি ড্রেন দখল করে বসে আছে। রাস্তার উপর বসানো এই দোকানগুলোর তথাকথিত মালিক আবার নিয়মিত (মাসিক বা ডেইলি হিসেবে) ভাড়া দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ যিনি দোকান বসানোর সুযোগ করে দেন তিনি বা তার লোক ওইসব দোকান থেকে ভাড়া তুলে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো এই রাস্তার ফুটপাতের উপর দোকানগুলো চালায় বাজারেরই সরকারি ডিসিআর কাটা কিছু অসাধু ঘর মালিক ও প্রভাবশালীরা। বাজারের গুরপট্টি, ময়রাপট্টি, কাপড় পট্টি, ধান হাটা, গরু হাটা, কাপড় পট্টি, স্বর্ণ পট্টি সহ প্রায় পুরো বাজারেরই একই চিত্র চোখে পরে।
ধরা যাক, আপনার কানাইপুর বাজারে একটি দোকান বা জায়গা আছে; তাহলেই আপনি ভাগ্যবান! ওই দোকানের এই পাশ, ওই পাশ, এমকি চারিপাশের সরকারি রাস্তাও আপনি দখল করে নিজের মনে করে ব্যবহার করতে পারবেন? আপনার ঘরের চারপাশের রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাতে আপনি একটু প্রভাব খাটিয়ে তা দখল করে, অবৈধ কিছু দোকান বসিয়ে ভাড়া দিয়েও ব্যবসা করতে পারবেন! হ্যাঁ পাঠক ঠিকই শুনেছেন, আপনি পারবেন, সত্যিই পারবেন আপনি? আসলে ঠিক এমনটি হচ্ছে বর্তমানে ফরিদপুরের কানাইপুর বাজারে।
অবৈধ দোকানগুলোর কারণে ওই রাস্তায় মানুষ ও যান বাহনের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি তারা এতোটাই প্রভাবশালী যে, খোদ কানাইপুর বাজার বণিক সমিতির নিষেধাজ্ঞায় মোটেও কর্ণপাত করেন না তারা।
এ বিষয়ে কানাইপুর বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তুষার খান উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, আমি অনেকবার এসব বিষয়ের সাথে জড়িতদের অনুরোধ করেছি, দখলকৃত সরকারি রাস্তা, ড্রেন ও ফুটপাতকে দখলমুক্ত করতে বলেছি, কিন্তু তারা শুনেন না। বিপরীতে তারা নানামুখী মানুষের তদবির ও ফোনের কারণে অনেক সময় আমাদের বাধ্য হয়ে সহ্য করে নিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। জনগণের ভোগান্তি হয়, যান চলাচলের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, শত বললেও তারা এগুলো গায়ে লাগান না বলেও জানান তুষায়।
কানাইপুর বাজারে অনেকেই এমন অবৈধ দখলের কাজে জড়িত। তা সরকারি জরিপ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে, সবাই নয়, কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা এমনটি করছেন, যার ফলে প্রতি নিয়তই কানাইপুর বাজারের প্রায় সবগুলো রাস্তা, ওলি-গলি' ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। বাজারের ভিতরের দিকের পূর্বের প্রসস্থ বেশ কয়েকটি রাস্তা এখন আর রাস্তা নেই বললেই চলে। এসব কে দেখবে? যারা দেখার কথা, তারা কতটুকু দেখেন? নাকি দেখেও অদৃশ্য কারণে না দেখার ভান করেন, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় বাজারের ভুক্তভোগী পথচারী ও ব্যবসায়ীদের মাঝে।
কানাইপুরে সাধারণত সপ্তাহে দুই হাটবার শুক্রবার ও মঙ্গলবার -এ রাস্তায় পাশের ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বসার সুযোগ দেয়া হতো। কিন্তু এখন বাজারের ভিতরে ঢোকার আগে থেকে শুরু করে সিনেমা হল রোডের বাজার প্রান্ত পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের ড্রেন, রাস্তার ফুটপাত ও রাস্তার কিছু অংশ দখল করে অনেক অস্থায়ী ব্যবসায়ীকে বেচাকেনা করতে দেখা যায়!
এদিকে, রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে দোকানপাট বসানো কোনভাবেই আইন সম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন করিমপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দীন চৌধুরী। তিনি বলেন, 'কেউ কেউ রাস্তা দখল করে অস্থায়ীভাবে দোকান করে তা ভাড়া দিচ্ছে খাচ্ছেন, এমন অভিযোগ আমাকে কেউ করেনি, আপনি করলেন, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ'।
তিনি আরো জানান, হাটের দিনে স্থানীয় কৃষক তাদের উৎপাদিত পন্য বিক্রি করতে রাস্তার দুইপাশে বসলে তা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু কেউ সরকারি রাস্তায় অস্থায়ী বা স্থায়ী কাঠামোতে দোকান করে ভাড়া তোলে খাবে এমন অভিযোগের সত্যতা মিললে সেটির বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ওসি সালাউদ্দিন আরো বলেন, 'আমি কানাইপুর বাজার বনিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে ব্যবস্থা নিবো'।
এসব বিষয়ে কানাইপুরের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রবীণ ব্যবসায়ী সমাজ ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা প্রায় সবাই-ই বাজার সংস্কার ইস্যূতে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
কানাইপুর বাজারের রাস্তা ও বাজারের সরকারি যায়গা দখলমুক্ত করে বাজারটিকে রক্ষা করতে হবে উল্লেখ করে কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফকির মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, 'আগে তো কানাইপুর বাজার ইউনিয়ন পরিষদের অধিনে ছিলো, এখন এটি জেলা প্রশাসনের অধীনে চলে গেছে। সুতরাং, এসব দেখার দায়িত্বও এখন জেলা প্রশাসনের। তিনি আরো বলেন, এর আগে হকারদের উচ্ছেদ করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েও তা করা হয়নি। বাজারটিকে একটি নিয়মতান্ত্রিক, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে, বাজারের সরকারি রাস্তা-ফুটপাত, ড্রেন দখলমুক্ত করতে হবে; সেই সাথে গরীব ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও যেনো তাদের ব্যবসা করার সুযোগ পায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে'।
কানাইপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন বলেন, 'কানাইপুর রাজারটিকে অবৈধ দখলমুক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে বাজারটিকে রক্ষা করতে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলে বিনীত অনুরোধ করছি'।
এ বিষয়ে কানাইপুর বাজারের বঢ়বসায়ী ও ইউনিয়ন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোতালেব শেখ ওরফে মোতালেব মেম্বার জানান, 'কানাইপুর বাজারের সংস্কারের স্বার্থে বাজারে ঢুকতে যদি আরেকটি বাইপাস রাস্তা তৈরী করার প্রয়োজন হয়, তবে আমি আমার মার্কেটের দোকান ভেঙে রাস্তা বের করে দিতেও প্রস্তুত আছি'।
অপরদিকে, অবৈধ দখলবাজদের কারণে কানাইপুর বাজারের রাস্তাগুলো দিয়ে জনসাধারণ ও যান বাহন চলাচলের বিঘ্ন ঘটছে উল্লেখ করে কানাইপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. সাইফুল আলম কামাল জানান, কানাইপুর বাজারের রাস্তা, ড্রেন ও ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করে সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই'। আর এমনটি বাস্তবায়নে কানাইপুর বাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের পাশাপাশি প্রশাসনেরও আন্তরিক হওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
কানাইপুর বাজারের ইজারা পেয়েছেন সাইফুল আলম কামাল। তিনি আবার সাব-কন্ট্রাকে তা দিয়েছেন জনৈক বিদ্যুৎ সাহা ওরফে বিদু নামের একজনকে। রাস্তা দখল করে বাজার বসানো বিষয়ে বিদ্যুৎকে বাজারের কয়েকজন স্থায়ী ব্যবসায়ী প্রশ্ন করলে বিদু ওই ব্যবসায়ীদের শুনিয়ে দেন, 'আমি কানাইপুর বাজারের রাস্তাও কিনে নিয়েছি!'
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, 'আল্লাহর কসম ভাই আমি এসব কাউকে বলি নাই, এগুলো ডাহা মিথ্যা কথা। আর আমিতো এই বাজারের মালিক না ভাই, বাজারের মালিক কামাল ভাই, আপনি যা জিজ্ঞেসা কারার তাঁকেই জিজ্ঞেস করেন। আসলে আমি কামাল ভাইয়ের হয়ে কামলা দেই মাত্র'। -'আমি কামাল ভাইয়ের সাথে কথা বলেই আপনাকে ফোন দিয়েছি' মর্মে জানালে বিদ্যুৎ সাহা তৎক্ষনাৎ ফোন কেটে দেন। অভিযোগ আছে, বিদুৎ সাহা ওরফে বিদু সাব-কন্ট্রাক নেওয়ার পর থেকে প্রতি হাটবারে কানাইপুর বাজারের অবস্থা আরও সূচনীয় হয়ে পড়ে। বাজার অব্যবস্থাপনায় যত্রতত্র দোকান বসিয়ে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ই বিদ্যুৎ সাহার প্রধান লক্ষ্য বলে অবিযোগ করেন কানাইপুর বাজারের কিছু বুনিয়াদি ব্যবসায়ী। এছাড়া, কেউ কেউ অভিযোগ করেন বিদ্যুৎ হাটের দিনগুলোতে কানাইপুর বাজার ছাড়াও বাজারে চারপাশে থাকা সংযোগ রাস্তাগুলোর ২/১ কি.মি. ভিতরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের থেকেও বাজারের খাজনা আদায় করেন বিদু। এই প্রতিবেদকের কাছে ওই ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে জানতে চান, কানাইপুর বাজারের সীমানা বাজারের বাইরে আসলেই কতোদূর? ব্যবসায়ীদের এমন প্রশ্নের সঠিক জনাব খুঁজতে ও আনুষাঙ্গিক বিষয়ে জানতে পরবর্তীতে বিদ্যুৎ সাহার সাথে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।
কানাইপুর বাজারে অনেকেই তার নামে থাকা জায়গায় ঘর তোলার সময় সরকারি বরাদ্দকৃত জায়গা থেকে এক চুল জায়গা ছাড় তো দেনই না, বরং পারলে তার জায়গার সাথে সরকারি আরও একটু জায়গা দখল করে বড় করে ঘর তোলার চেষ্টা করেন, এবং অনেকে তা করেছেনও। এই 'ব্যাড প্রাকটিস'টি অনেকেই করে থাকেন বিধায়ই কানাইপুর বাজারের রাস্তাগুলো দিনে দিনে সংকুচিত হতে হতে মানুষের হাঁটাচলার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এছাড়াও বাজারের ভিতরের মেইন রোডে সমিতি মার্কেটের পাশে মোটরসাইকেল পার্কিং করে রাস্তা দখল করে রাখা হয় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, যাতে ওই রাস্তার অন্যান্য যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল করতে অসুবিধা হয় বলে অভিযোগ করেছেন এলাকার ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিরা।
এমতাবস্থায়, কানাইপুর বাজারে বেদখল হয়ে যাওয়া সরকারি জায়গা, রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করে দোষিদের শাস্তির দাবি'র পাশাপাশি, নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও সরকারিভাবে বাজারটির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন কানাইপুর বাজারের সাধারণ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
(আরআর/এসপি/নভেম্বর ২১, ২০২৪)