মির্জাপুরে প্রতিবছরই ইটভাটার বহরে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ভাটা
স্টাফ রির্পোটার, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়নে গত বছর পর্যন্ত ১০১টি ইটভাটায় ইট তৈরি ও পুড়ানো হয়েছে। সরকারের অনুমোদন না নিয়েই এ বছর আবাদী জমিতে আরও সাতটি ইটভাটা নতুনভাবে স্থাপিত হয়েছে। ওইসব ভাটায়ও ইট তৈরি ও পুড়ানোর জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এই ইট পুড়াতে ভাটায় জালানি হিসেবে বিপুল পরিমান কাঠ স্তুপ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া নিয়ম না মেনে ওইসব অবৈধ ইটভাটায় বৈদ্যুৎ সংযোগও দেয়া হচ্ছে । বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে সঞ্চালন লাইন হতে ২ থেকে ৫টি খুটির মাধ্যমে ১৫ কেবির ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলার ১২ টি উপজেলার মধ্যে মির্জাপুর উপজেলা অন্যতম।এর আয়াতন ৩৭৩.৮৮ বর্গকিলোমিটার। উপজেলায় সমতল অংশে রয়েছে বংশাই,খাগজানা ও লৌহজং নদী। এছাড়াও ছোট-বড় খালবিলসহ পুকুর আছে ২০৪৩ টি। রয়েছে পৌরসভা আর সাধারণ মানুষের আবাসস্থল। পৌসভার আয়াতন ১৬.০৭ বর্গকিলোমিটার আর বনভূমি প্রায় ৩১ বর্গকিলোমিটার। বাকি ৩২৭ বর্গকিলোমিটারে ইটের ভাটা ,সাধারণ মানুষের আবাসস্থল,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,র্ধমীয় প্রতিষ্ঠান,সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত সহ অন্যান্য স্থাপনা। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়নে গত বছর পর্যন্ত ১০১টি ইটভাটায় ইট তৈরি ও পুড়ানো হয়েছে। সরকারের অনুমোদন না নিয়েই এ বছর আবাদী জমিতে আরও ৭ টি ইটভাটা নতুনভাবে স্থাপিত হয়েছে। নতুন ৭ টি ইটভাটাসহ মোট ইটভাটার সংখ্যা ১০৮টি। ভাটা মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে প্রতিটি ইটভাটা স্থাপনে প্রায় ১৫ একর জমির প্রয়োজন হয় । সে হিসেবে ১০৮ টি ইটভাটা স্থাপন করতে ২ হাজার ৭ শত একর বা প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার জমির প্রয়োজন।যা মোট সমতল ভূমির মোট আয়াতনের .৩৪ শতাংশ।এ উপজেলায় প্রতি ৩ বর্গকিলোমিটারে গড়ে উঠেছে ১টি ইট ভাটা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে , আইনের কোন তোয়াক্কা না করে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স ছাড়াই ভাটা মালিকরা ৭টি নতুন ইটভাটা তৈরি করেছেন। অবৈধ ভাটাগুলো হলো উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের বহুরিয়া গ্রামে আরবিসি ব্রিকস, এমএসবি ব্রিকস, বাটা ব্রিকস, চান্দুলিয়া গ্রামে এইচইউবি ব্রিকস, গোড়াই ইউনিয়নের দেওহাটা মল্লিকপাড়া গ্রামে সনি ব্রিকস, দেওহাটা পাথালিয়াপাড়া গ্রামে বিএন্ডবি ব্রিকস, দেওহাটা ও বাইমহাটী গ্রামে রান ব্রিকস। প্রত্যেক ইটভাটায় ১৪ থেকে ২০ একর আবাদী জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই নতুন ইটভাটা ছাড়াও এসব ভাটা মালিকদের একাধিক ইটভাটা রয়েছে বলে জানা গেছে।সব মিলিয়ে এ উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা দাড়িয়েছে ১০৮টি। এরমধ্যে কিছু সংখ্যক ভাটার লাইসেন্স থাকলেও অধিকাংশ ভাটার নেই বৈধ কাগজপত্র। এর অনেক ভাটাতেই নেই ট্রেড লাইসেন্স, ডিসি অফিসের লাইসেন্স, আবার কোন কোনটিতে নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। এছাড়া বেশ কিছু ইটভাটা সংরক্ষিত বনের পাশে স্থাপন করা হয়েছে।
তাছাড়া কোন কোন ইটভাটা ফসলি জমিতে এবং বিদ্যালয়ে পাশে গড়ে তুলা হয়েছে। অধিকাংশ ইটভাটার অপরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নবায়ন না হলেও থেমে নেই ইট পোড়ানো। এসব ভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হয় পাহাড়ি অঞ্চলের টিলা ও আবাদী জমির মাটি। পাহাড় কেটে সমতল ও আবাদী জমি করা হচ্ছে পুকুর। ভাটার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী একটি মহল নদীর পার কাটা মাটিও নিচ্ছে ভাটায়। ইট পোড়ানোর জন্য বিপুল পরিমান কাঠ স্তুপ করে রাখা হয়েছে। ভাটার কারনে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হওয়া ছাড়াও কমছে আবাদী জমি, অন্যদিকে মাটি পরিবহনে নষ্ট হচ্ছে কাচা-পাকা রাস্তা। এক কথায় কোন আইন মানছেন না ভাটা মালিকরা।ওইসব ভাটায় পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া হচ্ছে। তাও আবার সঞ্চালন লাইন হতে ২ থেকে ৫টি করে বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন করে ১৫ কেভির ট্রান্সফরমার দিয়ে বিদ্যুতের এই সংযোগ পাচ্ছেন ভাটা মালিকরা। বিদ্যুতের সংযোগ পেতে ভাটা মালিকরা লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
গত ৬ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মির্জাপুরে একটি প্রকল্প পরিদর্শনে আসেন। সেখানে গণমাধ্যমকর্মীরা অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণ ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, নতুন করে ইটভাটা নির্মাণের কোন সুযোগ নেই। বিদ্যুৎ সংযোগ বৈধও হয় আবার অবৈধও হয়। হোল্ডিং নম্বর না থাকলে বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার সুযোগও নেই। এখানেও অভিযান চালানোর আশ্বাস দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। বিভিন্ন পন্থায় ভাটা মালিকরা ভাটা স্থাপনে জমির শ্রেণি বা ফসল উৎপাদনে উপযোগী নন এমন পত্র সংগ্রহ করে থাকেন বলে অভিযোগে জানা গেছে।
উপদেষ্টার নির্দেশনায়ও অবৈধ ইটভাটা অপসারণে কাজ শুরু করেনি সংশ্লিষ্ট্য কর্মকর্তাগণ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়ার ১৫ দিন পার হলেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর।
মির্জাপুর পৌরসভা ও গোড়াই ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় উপজেলা পরিষদের কোয়ার্টার কিলোমিটার দুরে শামীম নামে এক ব্যক্তি আবাদী জমিতে রান নামে দ্বিতীয় ইটভাটা স্থাপন করেছেন। পাশেই তার এ নামে আরেকটি ইটভাটা রয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় ইটভাটাটি স্থাপন করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে লাইসেন্স ছাড়া ইট প্রস্তুত করা ও পোড়ানোর কোন সুযোগ নেই। আইন অমান্য করলে ভাটা মালিককে ২ বছরের কারাদন্ড বা ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডই হতে পারে। আইন অনুযায়ী কৃষিজমি, আবাসিক এলাকা, সরকারি বা ব্যক্তিগত বন, অভয়ারণ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন, বাগান বা জলাভূমিতে ইটভাটা স্থাপন না করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স ছাড়াই ভাটা মালিকরা ইট পোড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।তারপরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা উচ্চ আদালতে রিট করে এবং পেশিশক্তিতে এসব ইটভাটা চালাচ্ছেন বলে সূত্রটি জানিয়েছেন।
বহুরিয়া এলাকায় নবনির্মিত আরবিসি ব্রিকস এর মালিক মো. বেল্লাল মিয়া বলেন, তিনি ট্রেড লাইসেন্স ও কৃষি অফিসের ছাড়পত্র নিয়ে ইটভাটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার ইটভাটায় প্রায় ১৫ একরের বেশি আবাদী জমি রয়েছে।
দেওহাটা পাতিলাপাড়া এলাকায় আবাদী জমিতে নবনির্মিত বিএন্ডবি ব্রিকস এর মালিক সাবেক ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, তিনি তার ভাটার জন্য ১ হাজার ৪০০ শতাংশ জমি ভাড়া নিয়েছেন। প্রতি শতাংশ জমি ভাড়া হিসেবে ১৫০০ টাকা দিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সমাজসেবক বলেন, সরকার বলছে নতুন করে ইটভাটার অনুমতি আর দেয়া হবে না। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ অফিস সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে গড়ে উঠা ইটভাটাগুলিতে খুটি স্থাপন করে ট্রান্সফরমার বসিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছেন। আবার কৃষি কর্মকর্তা দিচ্ছেন প্রত্যয়নপত্র। ইউপি চেয়ারম্যান দিচ্ছেন ট্রেড লাইসেন্স। নতুন ভাটা স্থাপনে ভাটা মালিকরা এসব সুুবিধা কিভাবে পাচ্ছেন তা বুঝতে পারছি না।
পল্লী বিদ্যুৎ মির্জাপুর জোনাল অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমতিপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কথা না। তারপরও খোজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে তিনি জানান।
পরিবেশ অধিদপ্তর টাঙ্গাইল অফিসের উপপরিচালক মিয়া মাহমুুদুল হক উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছেন উল্লেখ করে অবৈধ ইটভাটার তালিকা দিয়ে তাকে সহযোগিতা করতে বলেন।
পল্লী বিদ্যুৎ টাঙ্গাইল অফিসের জিএম শেখ মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, খুটি ও ট্রান্সফরমার স্থপনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মির্জাপুর অফিসে জমা থাকে। অবৈধ ইটভাটায় সংযোগ দেয়ার সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
(এসএএম/এএস/নভেম্বর ১৯, ২০২৪)