নড়াইলের পানিপাড়া এখন পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য
রূপক মুখার্জি, নড়াইল : প্রতিবছরই বিভিন্ন দেশ থেকে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার নড়াগাতি থানার পানিপাড়া গ্রামের ‘কৃষি পর্যটনকেন্দ্র অরুনিমা ইকোপার্কে’ পাখি আসে। এবছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গেল দুসপ্তাহ হলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসতে শুরু করেছে। অতিথি পাখি আর দেশি পাখি মিলে নড়াইলের অরুনিমা রিসোর্ট ও গলফ ক্লাব এখন পাখিদের রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
নড়াইলের জেলা শহর থেকে প্রায় ৩১ কিলোমিটার দূরে নিভৃত পল্লীতে ৬২ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই রিসোর্টটি যেন পাখিদের এক আপন রাজ্য। সারাবছর এখানে পাখির দেখা মিললেও শীতের হাওয়া বইতেই ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখিরা ছুটে আসছে অরুনিমায়।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সরেজমিনে অরুনিমা রিসোর্টে গিয়ে দেখা গেছে, নড়াইলের নড়াগাতি থানার পানিপাড়া গ্রামে মধুমতী নদী থেকে সামান্য দূরে পিচ ঢালাই রাস্তার পাশে ‘কৃষি পর্যটনকেন্দ্র অরুনিমা ইকো পার্কে’ প্রায় দেড় শত বিঘা জমিজুড়ে বিভিন্ন গাছের ডালে গড়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কয়েক হাজার বাসস্থান। হাজার হাজার অতিথি পাখির কলতান দেশি-বিদেশি ভ্রমণ পিয়াসিদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
এলাকাতে দেশি-বিদেশি পর্যটক আসায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে কয়েক শত বেকার যুবকের। এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন বিকেলে গাছের ডালে বসতে থাকে এসব পাখি। রাত যত গভীর হয় পাখিদের আগমন তত বাড়তে থাকে। সারারাত পাখির কলতানে মুখরিত থাকে পুরো এলাকা। ভোর হলেই বেশির ভাগ পাখি উড়ে চলে যায়। আবার বিকেল হলে চলে আসে গন্তব্যে।
এখানে গেলে পুরো এলাকাজুড়ে আপনার চোখে পড়বে বক, হাঁসপাখি, পানকৌড়ী, শালিখ, টিয়া, দোয়েল, ময়না, মাছরাঙা, ঘুঘু, শ্যামা, কোকিল, টুনটুনি, চড়ুইসহ নাম না জানা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখির রাজত্ব। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার পাখির প্রজনন ঘটছে। ডিম থেকে ফুটছে বাচ্চা। বর্তমানে দেশের একমাত্র এই কৃষি পর্যটন কেন্দ্রটি পরিণত হয়েছে পাখির অভয়ারণ্যে।
আর এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে প্রতিনিয়ত দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে অসংখ্য পাখি প্রেমী ও বিনোদন প্রিয় মানুষ। এখানে পাখি শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই পাখিদের অন্তত পক্ষে মারা পড়ার ভয় নেই। আর এই ভরসাই এখানে দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে পাখির আনাগোনা। এ অভয়ারণ্যে যারা আসছেন তারা সবাই যেন পাখি সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন।
অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় পরিবেশ আর বিনোদনের আধুনিক সব সুযোগ সুবিধায় সন্তুষ্ট ভ্রমণপিপাসুরা। দেশের একমাত্র অ্যাগ্রো-ইকো-রিভারাইন-স্পোর্টস পর্যটন কেন্দ্র হল ‘অরুনিমা’। এর পুরো নাম অরুনিমা রিসোর্ট গলফক্লাব। ইতোমধ্যেই সেখানে ভিড় জমেছে বিনোদনপ্রিয় দেশি-বিদেশি বহু পর্যটকদের। তাদের পদভারে এখন মুখরিত কৃষিভিত্তিক পরিবেশবান্ধব এ পর্যটন কেন্দ্রটি।
পাখি দেখতে ঢাকা থেকে এসেছেন হুমায়ুন কবীর নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, সকালে পাখিগুলা এখান থেকে চলে যায় আবার বিকেলের দিকে ফিরে আসে। এ দৃশ্য ঢাকাতে বসে দেখা সম্ভব নয় তাই এখানে দেখতে এসেছি। খুবই ভালো লাগছে, ডিসেম্বর এর মাঝামাঝি আসলে হয়ত পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে। যারা বাইরে থাকেন তাদের অরুনিমা রিসোর্ট ও গলফ ক্লাবে পাখি দেখতে আসার আহ্বান জানান তিনি।
পাখি দেখতে আসা মিশান খান বলেন, প্রতিবছরই তিনি কখনও একা অথবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাখিদের এই অভয়ারণ্য দেখার জন্য এখানে আসেন। মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্য বিশেষ করে এখানকার পাখিদের এই অবাধ বিচরণের যে কোনো বিকল্প নেই তা এখানে না আসলে বোঝা যেত না। এখানে আসলে শুধু পাখিই নয়, দেখা যায় নানা প্রজাতির ফলজ, বনজ ও ওষুধি বৃক্ষ যেগুলো পাখিরা তাদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া এখানে রয়েছে নয়নাভিরাম একটি প্রাকৃতিক লেক যেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
এদিকে, প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত বিনোদনপ্রিয় মানুষ ও পর্যটক আসছেন এ অরুনিমা ইকোপার্কে। উপভোগ করছেন প্রকৃতিকে, আবার ফিরে চলে যাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আবাসিক সুবিধার জন্য এখানে রয়েছে সুইমিং পুল, এসি, নন-এসি ৩৪টি কটেজ। এক রুমবিশিষ্ট ভাসমান কটেজ রয়েছে দুটি।
এখানে আবাসিক বোটসহ প্রতিটি কটেজেই রয়েছে খাবারের সু-ব্যবস্থা। লেকের মাঝে রয়েছে দ্বীপ রেস্টুরেন্ট, চিত্রা কনভেনশন হল, এস এম সুলতান লাউন্স, দ্বীপ কটেজেস এবং সরকার অনুমোদিত টিপসি বার। ভাসমান ব্যাংককুয়েট। এ রেস্টুরেন্টে দেশি-বিদেশি খাবার, ফলের জুস, নিজস্ব খামারে উৎপাদিত সবজি ও মাছের ফ্রাইসহ আরও আছে বারবিকিউ। এখানে আছে ৪০০ জনের সেমিনার বা কন্ফারেন্সের ব্যবস্থা। এছাড়াও রয়েছে প্রায় একশ জনের আবাসিক সুবিধা।
অরুনিমা রিসোর্ট ও গলফ ক্লাবের ম্যানেজার মুনিব খন্দকার বলেন, অরুনিমা রিসোর্ট ও গলফ ক্লাব প্রকৃতি ভিত্তিক একটি রিসোর্ট। বছরে প্রায় ৮/৯ মাস দেশি ও পরিযায়ী পাখির মিলনস্থল এটা। এটা দেখতে দেশ ও বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক আসেন। এবারও শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগে থেকেই পাখি আসা শুরু হয়েছে এবং যত শীত বাড়বে পাখি আরও বাড়বে। মূলত পাখি আসার কারণ হচ্ছে আমরা এটাকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকি আমাদের সিকিউরিটির মাধ্যমে। তবে এটা সংরক্ষণে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়। যদি ফিনানশিয়াল সাপোর্ট আমরা পাই তাহলে এ সম্পদ সংরক্ষণে আমাদের বেগ পেতে হবে না।
নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কেয়া রেনু রায় বলেন, আমাদের দেশের পাখিকে সংরক্ষণ করার জন্য আইন আছে। তবে যতদিন মানুষ সচেতন না হবে ততদিন শুধু আইন বা বল প্রয়োগ করে পাখি সংরক্ষণ করা সম্ভব না।
তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর আগে শীত মৌসুমে জেলার বিভিন্ন এলাকার খালে, বিলে ও জলাশয়ে অতিথি পাখির বিচরণ থাকলেও কালের বিবর্তনে তা কমেছে। তবে নড়াইলের এই ইকোপার্কে প্রতিবছর পাখির সংখ্যা বাড়ছে বলছেন পার্ক কর্তৃপক্ষ।
(আরএম/এএস/নভেম্বর ১৫, ২০২৪)