রিয়াজুল রিয়াজ, ফরিদপুর : ফরিদপুরের কোতয়ালি থানার পুলিশ, ফরিদপুর র‍্যাব-১০ সহ স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফরিদপুর পৌরভার একটি সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরকে দেয়াল দিয়ে আটকে দিয়েছেন স্থায়ীয় লিটন সাহা নামে এক ব্যক্তি। পরে এলাকাবাসীর হট্টোগোল করলে ফরিদপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদ উজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) দুপুর ১২ টার দিকে ফরিদপুর পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের দিগনগর সাহাপাড়া সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরে প্রতিবেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রবেশ ঠেকাতে মন্দিরটিতে বাউন্ডারি দেওয়ার এমন ঘটনা ঘটে।

এর আগে গত রবিবার (১০ নভেম্বর) সকাল ১০টার দিকে প্রায় দীর্ঘ ৩০ বেশি সময়ে সার্বজনীন ওই দূর্গা মন্দিরটিতে দেয়াল দিতে গেলে এলাকার অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাধা দিলে একটি অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন ফরিদপুর কোতয়ালি থানার পুলিশ এসে সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের অংশটি সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার অনুরোধ করে উভয় পক্ষকে থানায় এসে তাদের লিখিত অভিযোগ জানাতে বলে।

আজ মঙ্গলবার সকালে ফরিদপুর র‍্যাব-১০ এর অফিসে উভয় পক্ষকে সমাধানের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। তথাপিও সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে লিটন সাহা স্থানীয় জৈনক বিল্লাল মাতুব্বর, ছত্তার মোল্যা, আব্দুল ওয়াহাব মেম্বার ও জৈনক ইসলাম মোল্যা ওরফে ইসলাম মাস্টার নামের কতিপয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে ওই মন্দিরে ইট দিয়ে দেয়াল তুলে ফেলেছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের এক অংশ। অভিযোগ আছে লিটন সাহা ওইসব প্রভাবশালীদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে মন্দিরের সামনে এনে দাড় করিয়ে রেখে এমন কাজ করেছেন। যদিও লিটন সাহা তাঁদের টাকা দিয়ে আনার অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা দাবী করে বলেন, 'তাঁরা এলাকার মাতুব্বরদের একাংশ এবং তাঁরা সবাই মুসলিম হলেও এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি'।

এদিকে, রাতে উভয় পক্ষের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে ফরিদপুর কোতয়ালি থানায় যেতে অনুরোধ করেছেন ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদ উজ্জামান।

আজ মঙ্গলবার বেলা দেড় টার দিকে ওই মন্দিরে ওসি আসাদ উপস্থিত থেকে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই পক্ষের হট্টগোল থামানোর পর, উভয় পক্ষকে কাগজপত্র নিয়ে থানায় আসার অনুরোধ করেছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। ওসি আসাদ আরও জানান, 'দিগনগর সাহাপাড়া সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরের উভয় পক্ষ থেকে দু'টি অভিযোগ করা হয়েছে। ওই অভিযোগ ও এলাকায় মন্দিরকে গিরে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিরামন বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে'। মন্দিরটিকে ঘিরে আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে এখানে না ঘটে, সে ব্যাপারেও পুলিশ সতর্ক থাকবে বলেও জানান ওসি আসাদ।

মন্দিরটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে সার্বজনীনভাবে পূজা অর্চনা করে আসছিলেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এলাকাবাসী পূজা উৎসব পালনের কথা চিন্তা করে সাহাপাড়ার রাস্তার পাশে এই মন্দিরটির জন্য তৎকালীন ৩ শতাংশ জায়গা দান করেছিলেন প্রয়াত রঞ্জিত সাহা। রঞ্জিত সাহা ওই মন্দিরের জায়গাটি দান করলেও জীবদ্দশায় তা দলিল করে দিয়ে যেতে পারেননি।

ওই মন্দিরের পুরোহিত নিরাপদ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, 'আমরা গত ২৬ বছর যাবত এখানে সার্বজনীনভাবে পূজা উদযাপন করে আসছি। আমার জানা মতে এই মন্দিরটি সরকারি যায়গায় উঠানো হয়েছে, যদিও স্থানীয় স্বর্গীয় রঞ্জিত সাহা (লিটন সাহার বাবা) এই মন্দিরের জন্য ৩ শতক জমি দান করে ছিলেন, কিন্তু তিনি লিখে দিয়ে যেতে পারেননি'। 'এতোদিন সার্বজনীন একটি দূর্গা মন্দিরকে হঠাৎ করে কেউ বাউন্ডারি তুলে আটকিয়ে দিয়ে সাধারণ হিন্দুদের বঞ্চিত করলে, তা এলাকার সাধারণ হিন্দু সমাজের মানার সুযোগ নেই বলেও জানান ওই মন্দির কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পুরোহিত নিরাপদ চক্রবর্তী।

এসব বিষয়ে জানতে লিটন সাহার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, 'আমার বাবা এই মন্দিরে তিন শতক জমি দিয়েছেন সেটা আমি অস্বীকার করছি না, আর মন্দিরটিতে বাইরের কেউ আসতে পারবেনা সেটাও আমি বলতে চাই না। বাড়ীর নিরাপত্তা ও নিজেদের নিরাপত্তার কারণে বাউন্ডারি দিয়েছি'। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, 'ভাই মন্দির আমাদের বাড়ীতে কিন্তু মদিরের কমিটিতে আমাদের কখনোই ভালো জায়গায় রাখা হয় নাই। মন্দিরের ব্যাপারে আমাদের কোন প্রকার মূল্যায়ণও করা হয় না। তাছাড়া মন্দিরটি আমাদের জায়গায়, আমরা যেভাবে চালাবো সেভাবেই চলবে। যার মন চায় সে আসবে, মন না চাইলে আসবেনা, সেটার তাদের বিষয়'। 'আরও অনেক কথা আছে আপনি সময় দিলে পরে বললো। আপনি পুরো ইতিহাস লেখবেন, যদি না লেখেন তবে- আমি নিজে লেখে বই করে ছাপিয়ে মানুষের মাঝে বিতরণ করবো' বলেও জানান লিটন সাহা।

এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উভয় পক্ষ কাগজ পত্র নিয়ে ফরিদপুর কোতয়ালি থানা ও ফরিদপুরের র‍্যাব-১০ এর অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে, দিগনগর সাহাপাড়া সার্বজনীন দূর্গা মন্দিরকে ঘিরে ওই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই পক্ষের মধ্যে একটি চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।

(আরআর/এএস/নভেম্বর ১২, ২০২৪)