স্টাফ রিপোর্টার : বছর ৩/৪ পূর্বে সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ বিনামূল্যে ৩০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যে 'বীরনিবাস' করে দেয়ার লক্ষ্যে যে প্রকল্প অনুমোদন করেছিলো তা কোনো মতেই বাস্তবসম্মত ছিলো না। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সিংহভাগ অর্থই স্থানীয় এমপি, উপজেলা কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও অন্যান্য সুযোগ সন্ধানীচক্রের পেটে চলে গেছে, ফলে গোঁজামিল দিয়ে তৈরি জরাজীর্ণ ও নড়বড়ে বীরনিবাস অল্পদিনের মধ্যেই বসবাসকারীদের জন্য অভিশাপ ডেকে এনেছে। এটাকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বেদনাদায়ক তামাশা বলে অভিহিত করেছেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান লেখক গবেষক আবীর আহাদ।

তিনি বলেছেন, দেশের ৯০% শতাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা চলে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছেন। এ অবস্থায় ঐ তথাকথিত ৩০ হাজার বাড়ি কারা কীভাবে পেলেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তাছাড়া বিরাট সংখ্যক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে সেজন্য কতোটি বছর অতিবাহিত হবে এবং ততোদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন কিনা তা কি কেউ কখনো ভেবে দেখেছেন? এ-ব্যতীত প্রত্যেক উপজেলায় প্রকৃতই গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি খরচে নির্মিত বাড়ি পেয়েছেন- তার কী কোনো নিশ্চয়তা আছে?

আবীর আহাদ বলেন,অভিযোগ পাচ্ছি, গত দু'বছর ১৪ হাজার বীর নিবাস নিয়ে উপজেলা পর্যায়ে একশ্রেণীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনচক্রের যোগসাজশে পর্দার অন্তরালে সর্বোচ্চ ঘুষদাতা মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিমও গ্রহণ করেছিলো বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিলো! এ-প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিযোগিতায় কোনো প্রকৃতই গৃহহীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা নয়, বাড়িগুলো পেয়েছে টাকাওয়ালা ও রাজনৈতিক যোগাযোগের অবস্থাসম্পন্ন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। গত দু'বছর আগে বিভিন্ন উপজেলা থেকে ১৪ হাজার তথাকথিত সরকারি বীরনিবাস প্রাপকদের যে তালিকা সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছিলো তার মধ্যে উপরোক্ত আশংকার সত্যতা পাওয়া গেছে।

আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে আবীর আহাদ উপরোক্ত মন্তব্য করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তথা সাবেক সরকার যতোগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো তার কী পরিমাণ বাস্তবায়ন ঘটেছে তা কেউ না জানলেও আমরা জানি। ইতিপূর্বেকার নানান গালভরা কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতিটি বক্তব্য ফাঁপা বুলিতে পরিণত হয়েছিলো।

আবীর আহাদ আরও বলেন, গত ২০ অক্টোবর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীরপ্রতীকের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে আমরা বলেছি, অতীতে সরকারের জরাজীর্ণ বীরনিবাসের পরিণতির আলোকে প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা কেটে নেয়ার শর্তে এককালীন নামমাত্র সুদে ২৫ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদান করুন, যাতে দেশের স্বাধীনতা আনায়নকারী বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই সরকারী নকসা অনুসরণ করে বীরনিবাস নির্মাণ করে স্বস্তিতে মাথা গুজতে পারেন। যা করার তা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিতকালের মধ্যেই করতে হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে আর তেমন বেশি দিন থাকবেন না। এছাড়া আগের তথাকথিত ১৪ হাজারসহ মোট ৩০ হাজার বাড়ি বরাদ্দকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে টানাপোড়েনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে চরম রেষারেষি ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সব গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাই তো এ-সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকারী। সবাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে গিয়েছিলো।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ ছোটো বা কেউ বড়ো মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই। সবাই মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি দিতে হলে সবাইকে দিন, অন্যথায় এ অবাস্তব দুর্নীতিগ্রস্ত নড়বড়ে জগাখিচুড়ি ও হানাহানিপূর্ণ পরিকল্পনা বাদ দিন। তারচে' ভালো, একই ডিজাইনের নির্দেশনার আলোকে সবাইকে গৃহঋণের আওতায় ছেড়ে দিন। যার প্রয়োজন সে ঋণ নেবে অথবা নেবে না। এতে সবাই একটি সান্ত্বনা পাবে। খয়রাতির বদনাম থেকে তারা কিছুটা মুক্তি পাবেন। কোনো মন খারাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না, হবে না কোনো হানাহানি। অপরদিকে এ ঋণের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপীও হবেন না। কারণ তারা ঋণ নেবে তাদের ভাতার বিপরীতে, যে ভাতাটি রয়েছে সরকারেরই হাতের মুঠোয়। ভাতাটিই তাদের ঋণের নিরাপত্তা- কো-লেটারাল সিকিউরিটি হিশেবে পরিগণিত হবে। সুতরাং সরকারের কাছে আমার আবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না করে, তাদের মনে ব্যথা না দিয়ে অবিলম্বে তথাকথিত বীরনিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে সবার জন্য গৃহঋণের সুব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এতে চিরবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের বেদনার্ত বুকে একটা অপার শান্তি ও সান্ত্বনা বয়ে আনবে।

(পিআর/এসপি/নভেম্বর ১২, ২০২৪)