শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : বটগাছ একটি, তবে কয়েক একর জায়গা জুড়ে এর পরিধি। অনেকে বলে থাকেন ঝিনাইদহের এই গাছটি নাকি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বটবৃক্ষ। যদিও মানুষের অত্যাচারে নিজের মত নেই কালের এই সাক্ষী। সামাজিক বন বিভাগ গাছটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলেও দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এই নিদর্শন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলি গ্রামের বটগাছ এটি। সামাজিক বন বিভাগের খাতায় যা এশিয়া মহাদেশের প্রাচীন ও অন্যতম বড়। অযত্ন অবহেলায় আগের সেই ‘শ্রী’ অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গেছে বৃহত এ বটবৃক্ষের। গাছটি সংরক্ষণের বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০০৯ সালে দেখভালের দায়িত্ব নেয় সামাজিক বন বিভাগ। কিন্তু তা নামমাত্র। গাছটির আশপাশে বন-জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। সাথে রয়েছে ময়লা আবর্জনায় স্তুপ। যা দেখে ক্ষোভ ঝাড়ছেন স্থানীয়রা।

প্রতিদিনই বটবৃক্ষটি দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে অনেকেই আসছেন এই গ্রামে। অবাক চোখে দেখছেন প্রকৃতির এ বিস্ময়কে। গাছটির শুরু একটি মূল থেকে, আর এখন মূলের সংখ্যা কয়েকশ। ছড়িয়ে পড়া ডালপালা আর পত্রপল্লবে কয়েকশ বছরের পুরোনো গাছটির ব্যপ্তি বর্তমানে ১১ একর জায়গা জুড়ে। তবে অবহেলা অযতেœ আপন সৌন্দর্য আর ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বৃহত্তম এই গাছটি। সংরক্ষন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এশিয়াবাসীর গর্ব এই গাছটি আর কতদিন টিকে থাকবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আনুমানিক ৩’শ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এই বটগাছটির বর্তমান বিস্তৃত এলাকা ১১ একর। বটের ডালপালা ও শিকড় নেমে পুরো এলাকাটি দৃশ্যত পৃথক গাছে পরিণত হয়েছে। মূলগাছ কোনটি তা আর এখন বোঝার উপায় নেই। গাছটির জন্ম কত সালে তার কোন সঠিক ইতিহাসও কারো জানা নেই। তবে বয়ঃবৃদ্ধদের মূখে শোনা যায়, গাছটির বয়স ৪শ বছরের বেশী হবে। বাংলা ১৩৬০ সালে এই গাছটিকে কেন্দ্র করে মল্লিকপুর বেথুলীতে প্রথম বাজার বসে। বাজারটি এখন অনেক বড় বাজারে পরিনত হয়েছে। গাছের সঙ্গে অনেক বড় হয়ে উঠেছে বাজারটি। দোকানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বর্তমানে ৫৫ থেকে ৬০ টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ওই বাজারে।

বাজারের প্রথম ব্যবসায়ী মল্লিকপুরের মুনসুর আলী,মোনতাজ আলী,আব্দুল হামিদ, বেলায়েত মিয়া, বেথুলী গ্রামের স্বারজিত বিশ্বাস প্রমুখ। উল্লেখিত ব্যক্তিরা প্রথম টং দোকান বসিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন সেখানে গড়ে তুলেছেন স্থায়ী পাকা ইমারত ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান।

১৯৮২ সালে বিবিসি’র এক তথ্যানুযায়ী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজায় অবস্থিত সুইতলা-মল্লিকপুরের বটগাছটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহত্তম বটগাছ। তখন থেকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এ বটগাছের কথা। এরপর দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী গাছটি দেখতে আসা শুরু করেন।

গাছটির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ৪’শ বছরের বেশি সময় পূর্বে গাছটি ছোট থাকা অবস্থায় তার নিচে একটি কুয়া ছিল। কুয়ার পানি ছিল স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। কম জনবসতি এলাকাটিতে দুর-দুরান্তের লোক এই কুয়ার পানি পান করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যেত। কুয়ার উপরের বটগাছটির ডালপালা প্রচুর হওয়ায় গাছের নিচে গরমের সময় ঠান্ডা আর ঠান্ডার সময় গরম অনুভূত হতো। ধীরে ধীরে জনসাধারনের মধ্যে গাছটি পূণ্য স্থানে পরিণত হয়। বিভিন্ন রোগের জন্য আগত লোকজন গাছের গোড়ায় মানত করতে শুরু করে। সাধারণের মাঝে বিশ্বাস জাগতে শুরু করে যে গাছটির ডাল কাটলে বা ক্ষতি করলে নিজেদের ক্ষতি হতে পারে। তাই গাছটিকে সবাই পরিচর্যা করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে গাছটির ডালপালা থেকে বোয়া নামতে নামতে বৃহৎ আকার ধারণ করে। কিন্তু মানুষ আজ আর কোন নিয়ম মানে না, ভয়ও পাইনা।

১৯৮২ সালে বিবিসির জরিপে বটগাছটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ বট গাছ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকেই এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ও স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সংরক্ষনের উদ্দ্যোগ নেয় সরকার। সরকারের পাশাপাশি এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে গাছটির চারপাশ দিয়ে ১১ একর (৩৩) বিঘা জমির উপর দেওয়া হয় সীমানা প্রাচীর। গাছের পাশে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় একটি রেষ্ট হাউজ। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে গাছের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় পাকা বেঞ্চ ও গার্ডেন ছাতা সংযোজন করা হয়। রেষ্ট হাউজ নির্মিত হওয়ার পর বটগাছের পাশে ১৬৯ মৌজার ১৬নং দাগে ৩২ শতক জমি মল্লিকপুর গ্রামের মৃত জহুর আলী বিশ্বাসের স্ত্রী কুন্টি বিবি ২৫/০৪/৯০ ইং তারিখে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের নামে দানপত্র দলিল লিখে দেন।

সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকতুল ইসলাম ঐতিহ্যবাহী স্থানটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি ঘটাতে গাছের নীচে বিভিন্ন ফুলের গাছ রোপন করেন। কিন্তু সরকার এসব দেখভাল না করায় দীর্ঘদিন অরক্ষিত থেকে সরকারি টাকায় নির্মিত রেষ্ট হাউজটি নেশাখোরদের দখলে চলে গেছে। নেশাখোরেরা রেষ্ট হাউজের জানালা দরজা লোহার গ্রীল সবই কেটে নিয়ে গেছে। রেষ্ট হাউজটি এখন পরিত্যাক্ত। এছাড়া এলাকার প্রভাবশালী মহল রাতে গাছের বড় বড় ডালপালা পর্যন্ত কেটে নিয়ে গেছে। মানুষের নানাবিধ অত্যাচারে সৌন্দর্যবর্ধনকারী এই বট গাছটি তার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে এশিয়াবাসীর গর্ব এই বৃহৎ বটগাছটি আর কতদিন তার আপন ঐতিয্য ও সোন্দর্য ধরে রাখতে পারবে তা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেন সুইতলা-মল্লিকপুরবাসী।

গত ২২ বছর ধরে বিশাল এই বটগাছগুলো দেখভালের দায়িত্বে থাকা একমাত্র মানুষ আব্দুল খালেক জানান, ‘গত চার বছর হলো সম্মানী পান মাত্র ১ হাজার ৮শত টাকা। পুরো ১১ একর জমি জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এলাকাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নসহ বট গাছের ‘ব’ নামানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও করেন তিনি। তার অন্য ৩ সন্তানের মতোই ভালোবাসেন বটগাছটিকে। কিন্তু গাছটির ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কিত তিনি।’

সুইতলা মল্লিকপুরের ৭০ বছরের বৃদ্ধ আবুল হাসেম জানান, ‘চরম অযত্ন-অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নানামুখী অত্যাচারের কারণে এই ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যেটি হতে পারতো দেশের অন্যতম টুরিস্ট স্পট বা অর্থনৈতিক জোন কিন্তু তা আজ নিঃশেষ হওয়ার পথে।’

জামাল উদ্দিন জানান, ‘একসময় গাছটির দুই হাজার ঝুরি ছিল। এখন সেই ঝুরির সংখ্যা কমে কয়েক শ’তে নেমে এসেছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে ১৯৯০ সালে সরকারীভাবে একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সবই আজ ধ্বংসের পথে। ফলে দেশ বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের পড়তে হয় দুর্ভোগে।’

চুয়াডাঙ্গা থেকে দেখতে আসা আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ দেখতে আসে এ বটগাছটি। অনেক দিন ধরেই এই বটগাছটি দেখার ইচ্ছে ছিল। দেখলাম,মনটা ভরে গেল। দেশে যে এত সুন্দর প্রাকৃতিক সৃষ্ট সম্পদ রয়েছে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

বটবৃক্ষটি দেখতে আসা রাকিন হাসান বলেন, ‘নানাভাবে গাছটির গল্প শুনে দেখতে এসেছি। অনেক গাছ মরে গেছে। ভেতরে বনজঙ্গলে ভরা। সাপ-পোকার ভয়ে পা ফেলতেও ভয় করছে।’

কোলা বাজার এলাকা থেকে গাছটি দেখতে যাওয়া আতিয়ার রহমান বলেন, ‘বাড়িতে আত্মীয় আসায় তাদের নিয়ে ঘুরতে এসেছি এখানে। তবে ভেতরের পরিবেশ খুবই খারাপ। ভাঙ্গা ডালপালা যেখানে-সেখানে পড়ে আছে। অনেকগুলো গাছও মরে গেছে। সরকারীভাবে গাছগুলো সংরক্ষণের উদ্যেগ না নিলে ঐতিহ্য হারাবো এশিয়া মহাদেশের বৃহত এ বটবৃক্ষ।’

গাছটি সংরক্ষণ ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি সেখানে গিয়েছিলাম। অনেক গাছ মরে গেছে। ভেতরে বনজঙ্গলে ছেয়ে গেছে। শীঘ্রই তা পরিস্কার করা হবে এবং গাছটি রক্ষায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা হবে।’

(এসআই/এসপি/নভেম্বর ১১, ২০২৪)