খলিষাখালীতে ভূমিহীন নেতা কামরুলকে পিটিয়ে হত্যা
নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম ও মাছ আনারুলসহ ২৩ জনের নামে মামলা
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : গত পহেলা নভেম্বর সেনাবাহিনীর টহল শেষে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের ভূমিদস্যু আজিজুল ইসলাম, মাছ আনারুল ও পারুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবুর নেতৃত্বে ভূমিহীন নেতা কামরুল ইসলামকে (৪২) পিটিয়ে হত্যাসহ ২০ জন ভূমিহীন নারী ও পুরুষকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের স্ত্রী মর্জিনা বেগমের দায়েরকৃত এজাহারটি হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
এদিকে কামরুল হত্যার ঘটনায় মামলা রেকর্ড হওয়ার পর আসামিরা নতুন করে পরিকল্পনা শুরু করেছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ৫ আগষ্ট শ্যামনগর থানা থেকে লুট হওয়া দুটি অস্ত্র উদ্ধারে গত ২ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে সেনাবাহিনী খলিষাখালি ও নোড়ারচক এলাকায় অভিযান চালায়। একই সময়ে গাজীরহাট, ডেলটা মোড়, পারুলিয়া ও বাবুরাবাদ থেকে নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, তার ব্যবসায়িক পার্টনার আনারুল ইসলাম (মাছ), পারুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু, সাবেক চেয়ারম্যান শেখ সিরাজ, আইডিয়ালের নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম, সুরুজ কাজী, সখীপুরের আব্দুল আজিজ, রামনাথপুরের জব্বার গাইনের ছেলে আলিম গাইনের নেতৃত্বে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইন্ত্রনগরের শাহীনুর পাড়, মনিরুজ্জামান মনি, ইসরাফিল, শফিকুল সরদার, ঢেবু খালির আবু তালেব, তালার মাছিয়াড়া গ্রামের পাখরা হালিম, কৃষ্ণনগরের বাহার আলী, ইন্দ্রনগরের শহীদুল ইসলাম, তার ভাই রবিউল ইসলাম বুল্লা, নোড়ার ইসাদ আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম, শাহাজাহানের ছেলে রবিউল ইসলাম, আটশত বিঘার শওকত হোসেন, পলগাদার ষেখ আব্দুল মাজেদের ছেলে খোঁড়া শফি, একই গ্রমের ইউসুফ মুন্সির ছেলে সেলিম, শহীদুল, শফিকুল, জেহের আলীর ছেলে শহীদুল, বসিরাবাদ মৌখালির সৈয়দ ঢালীর ছেলে সাঈদুল ঢালী, আকবর সরদারের ছেলে রিয়াজুল ইসলাম, ইন্দ্রনগরের সেকেন্দার, মকিম শেখের ছেলে রেজাউল শেখ, জিয়াদ গাজীর ছেলে আব্দুল বারি, নওশের গাজীর ছেলে সবুর গাজী, এসহাক গাজীর ছেলে আদম গাজী, সামাদ শেখের ছেলে আইয়ুব শেখ, পূর্ব নলতার ইমান আলী মোল্লার ছেলে মাষ্টার শহীদুল, বাবুরাবাদের জেহের আলীর ছেলে আব্দুস সবুর ও শফিকুল, আশাশুনির গোদাড়ার পুলিশের দালাল মহিউদ্দিন, বালিয়াপুরের মোক্তার হোসেনসহ দুই শতাধিক শসস্ত্র সন্ত্রাসী ট্রাকে, মটর সাইকেলে ও পায়ে হেঁটে খলিশাখালিতে যায়।
তারা তথ্য গোপন করে সেনাবাহিনী দিয়ে অভিযান পরিচালনা শেষে ভূমিদস্যু সুরুজ কাজীর দাবিকৃত বাসায় ও পার্শবর্তী এলাকায় ভূমিহীনদের উপর হামলা চালায়। এ সময় তারা নোড়ারচকের কয়েকটি বাড়ি থেকে পাঁচটি মটর সাইকেলসহ ভূমিহীনদের ঘর থেকে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার মালামাল লুটপাট করে। হামলায় খলিষাখালির ভূমিহীন নেতা তার স্বামী কামরুলসহ ২০ জন মারাত্মক জখম হয়। নিজেদের মজুত রাখা দা, বোমা ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রসহ ভূমিহীন রবিউল আওয়াল, মহরম, নুরুজ্জামান, হাসিবসহ ছয়জনকে ধেের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় ভূমিদস্যুরা। ভূমিদস্যুদের হাতে নিহত কামরুলকে সেনাবাহিনীর গাড়ির পিছনে পিছনে মটর সাইকেলে বসিয়ে বাবুরাবাদের জেহের আলীর ছেলে আব্দুস সবুর ও শাহজাহানের ছেলে রবিউল স্বাস্থ্য কমপ্লেস্কের জরুরী বিভাগের সামনে ফেলে চলে আসে। আজিজুর রহমান ও মাছ আনারুলের নেতৃত্বাধীন হাফ প্যান্ট পরিহিত সন্ত্রাসীরা নলতার মাছ আনারুলের অফিসের পাশের ঘরে অস্ত্র শস্ত্র ও একটি ব্যাগ ভর্তি মোবাইল রেখে সুন্দরখালিতে চলে যায়। ওই ছয় ভূমিহীনদের বিরুদ্ধে দেবহাটার রামনাথপুরের জব্বার গাইনের চেলে আব্দুল আলীম গাইন বাদি হয়ে গোলাম কাজীর ঘেরের লীজ গ্রহীতা হিসেবে ২ নভেম্বর মামলা করেছে।
মর্জিনা বেগদ জানান, জালজাতিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরিকারি ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সাবেক পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে শহরের পিএনি হাইস্কুলের কাছ থেকে গ্রেপ্তার করান দৈনিক সাত নদী পত্রিকার সম্পাদক হাবিবুর রহমান। তাকে হত্যার পর লাশ গুম করার পরিকল্পনা করা হয়। সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে গুম করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় হাবিবুর রহমান ছুঁটে যান জাতীয় দৈনিক বাংলা ৭১ পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর শিকদারসহ বিভিন্ন জায়গায়। কয়েকজন সাংবাদিককে ফোন করে রঘুনাথ খাঁসহ ভূমিহীন নেতাদের বিরুদ্ধে নিউজ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন হাবিবুর রহমান। এরপরও পহেলা নভেম্বর সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পরপরই হাবিব খলিষাখালিতে এসে অন্যান্য হামলাকারিদের উস্কে দেন ভূমিহীনদের উপর হামলা জোরদার করতে। অংশ নেন হামলায়। একপর্যায়ে তিনি বাদি হয়ে ৩ নভেম্বর থানায় এজাহার দাখিল করেন। এরপর থেকে হামলাকারিদের অনেকেই বিএনপি নেতা হওয়ায় আইন প্রয়োগকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের মি থ্যা তথ্য দিয়ে মামলা না হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকি রবিবার জেলা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মাসিক মিটিং এ তার স্বামী হত্যা ও খলিষাখালির ১৩১৮ বিঘা লাওয়ারিশ সম্পত্তি নিয়ে উপস্থাপন করা হয়। রাতেই মামলা রেকর্ড করা হয়।
দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ হযরত আলী সাংবাদিকদের বলেন, মর্জিনা বেগমের দায়েরকৃত হত্যা মামলাটি (৪নং) রবিবার রেকর্ড করা হয়েছে। পুলিশ আসামী ধরতে চিরুনী তল্লাশি চালাবে।
প্রসঙ্গত,জাল জালিয়াতের মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরী করে দেবহাটার শিমুলিয়ার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, সুরুজ কাজী, সখিপুরের আব্দুল আজিজ ও একই এলাকার বেসরকারি সংস্থা আইডিয়ালের নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম, পারুলিয়ার ইকবাল মাসুদ সহ বেশ কয়েকজন ভূমিদস্যূ জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে চণ্ডিচরণ ঘোষের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি ১৯৫৫ সাল থেকে দখল করে আসছিলো। ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই জমি লাওয়ারিশ হিসাবে ঘোষণা করে। এরপর ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে সাপমারা খালের দুই ধার থেকে উচ্ছেদ হওয়া প্রায় ৮০০ পরিবার সেখানে বসবাস করে আসছিলো। প্রশাসন যাতে তাদের উচ্ছেদ না করতে পারে সেজন্য ভূমিহীনদের পক্ষ থেকে মহামান্য হাইকোর্টে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৫০০/২২ নং রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়।
আদালত ভূমিহীনদের বসবাসের সুবিধার্থে স্থিতাবস্থা জারি করে। যাহা আজও চলমান। স্থিতাবস্থা জারি থাকার পরও ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর তৎকালিন পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানের সহায়তায় ভূমিদস্যুরা ভূমিহীনদের ৭৮৫টি বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এরআগে ভূমিদস্যূদের দায়েরকৃত মামলায় খালাস পাওয়া আসামী শরিফুল, কামরুল (শুক্রবার নিহত) ও মুর্শিদকে আদালত থেকে ধরে এনে ডাকাতির চেষ্টা ও অস্ত্র মামলায় কোর্টে পাঠায় পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও নির্যাতনের খবর প্রকাশ করায় সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি শহরের পিএন হাইস্কুল এর পাশ থেকে তুলে নিয়ে তাকে গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালান তৎকালি পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান। এ সময় রঘুনাথ খাঁর নামে একটি নাশকতা ও একটি চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়। একই দিনে ভূমিহীন ইউনুসকে বদরতলা মাসের সেট থেকে তুলে এনে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে জমির মালিক দাবিদাররা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে সিভিল রিভিউ পিটিশন দাখিল করলে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি ওই রিভিশন খারিজ করে দেন।
(আরকে/এসপি/নভেম্বর ১১, ২০২৪)