ভৈরবের পল্লীতে ২ বংশের সংঘর্ষে নিহত ১
গ্রেপ্তার এড়াতে বাড়ি ছাড়া প্রায় ৫ হাজার নারী-পুরুষ
সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : ভৈরবে টানা তিনদিনের সংঘর্ষে বাড়ি ছাড়া প্রায় ৫ হাজার নারী-পুরুষ। নিয়মিত ঘটে যাচ্ছে ভাঙচুর লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা। ৩১ অক্টোবর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কাইয়ুম মিয়া নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়। এরপর থেমে নেই সংঘর্ষ। থেমে থেমে চলছে ভাঙচুর লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ। কিছু মানুষ এলাকায় থাকলেও তাদের ভিটে মাটি ছাড়া বাড়ি ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই, এমনকি খাবার পানির টিউবওয়েল ও বাথরুমও ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে কিছু মানুষ।
দীর্ঘ ৫৪ বছর যাবত চলমান রয়েছে উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের মৌটুপি গ্রামে সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা তোফাজ্জলের নেতৃত্বাধীন কর্তা বাড়ি ও বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মো. সাফায়েত উল্লাহ’র নেতৃত্বাধীন সরকার বাড়ির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ৩১ অক্টোবর সংঘর্ষে কাইয়ুম মিয়া নিহত হলেও ওই দিন আহত হোন অর্ধশতাধিক। এ ঘটনায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দুইদিনে উভয় পক্ষের ৯ জনকে আটক করে যৌথবাহিনী। জব্দ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র। দুই বংশের এই সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার এড়াতে ও বাড়ি ঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে এলাকা ছাড়া দুই বংশের প্রায় ৫ হাজার নারী ও পুরুষ।
আজ শনিবার মৌটুপি এলাকার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকায় ভুতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। দুদিন আগেও যেখানে ঘর ছিলো, আজ সেখানে কোন ঘর নেই, আছে শুধু ভিটেখানি। কারো খড়ের গাদা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, আবার কারো বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে গরু-বাছুর, ছাগল, হাঁস-মুরগী, আসবাবপত্রসহ সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। এমনকি দালান ঘরের দরজা, জানালার গ্রীল ও আসবাবপত্র সবকিছুই নিয়ে গেছে উভয় পক্ষের লোকজনের। এলাকা এখন সুনশান অবস্থায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
কেউ বসে আছে নিজের ভাঙ্গা ঘরের ছাউনির নিচে। কেউ মাটি কামড়ে বসে আছে মরতে হলে নিজ ভিটেতেই মরবেন বলে। এদিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নিয়মিত টহল দিয়ে যাচ্ছে।
এসময় কথা হয় মৌটুপি গ্রামের বাসিন্দা বয়োজ্যেষ্ঠ নুরজাহান বেগমের সাথে। তিনি বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। আমারও কমড়ে সমস্যা। কিছু মানুষ এসে বলে বাড়ি থেকে বের হও। না হলে আগুন লাগিয়ে দিবো। আমি আমার অসুস্থ স্বামীকে রেখে কোথায় যাবো মরতে হলে বাড়িতে পড়েই মরবো।
এসময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নারী বলেন, বাড়িতে থাকতে আমাদের কিছু মানুষকে টাকা দিতে হচ্ছে। আমাদের বাড়ি-ঘরসহ পানি খাওয়ার টিউবওয়েল ভেঙ্গে সাথে বাথরুমও ভেঙ্গে ফেলেছে। কিছু বাড়িতে চাল আছে টিন নেই। বিল্ডিং বাড়িতে ছাদও নেই। আমাদের সহযোগিতা করার কোন মানুষ নাই। সারা রাত জেগে থাকি কখন জানি কি হয়। কেউ আগুন লাগাচ্ছে কেউ আবার লুটপাট করছে।
এলাকাবাসী ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার ও শনিবার সকালে র্যাব, সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে উভয় পক্ষের ৯ জনকে আটক করে। শুক্রবার আটক হয় বর্তমান চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ গ্রুপের মো. রহমত উল্লাহ (৬৫) ও চাঁন মিয়া (৫৫) এবং সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল গ্রুপের বাতেন মিয়া (৫৩), রফিকুল ইসলাম (৬০), নজরুল ইসলাম (৫০), শরীফুল ইসলাম (২১), পাবেল (২৩)। শনিবার আটক হয় তায়েব উদ্দিন ভূইয়া ও আমিনুল ইসলাম জাহিদ। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণের দেশীয় অস্ত্র। আটককৃতদের শনিবার গ্রেপ্তার দেখিয়ে কিশোরগঞ্জ জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এদিকে এলাকাবাসীরা আরো বলেন, ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ড নিয়ে মৌটুপি গ্রামে ৭ হাজার মানুষের বসবাস। আসছে কার্তিক মাস। গ্রামের মানুষের চাষাবাদের সময়। এই মৌসুমে মাষকলাই, মুগডাল, সরিষা, ধান, আলু, মরিচ, বোরো ধানের চারা (জালা), ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলাদী চাষ হয়। সংঘর্ষে গ্রাম ছাড়া মানুষগুলোর জন্য পতিত থাকবে কয়েকশ বিঘা জমি। বছরের শেষ সময়ে লেখা পড়ার ক্ষতি হচ্ছে গ্রামের ছেলে মেয়েদের।
গ্রামের শান্তি ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ভৈরবের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগীতা কামনা করছেন এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে মৌটুপি ২নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য রিপন মিয়া বলেন, মৌটুপি গ্রামের মানুষ এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। এলাকা ছাড়া আছে ৭০% নারী পুরুষ। কর্তা বাড়ি ও সরকার বাড়ির দ্বন্দ্বে তিনদিন যাবত ৬ থেকে ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি দাবী করেন। এসময় এলাকার শান্তি ফেরাতে প্রশাসনসহ ভৈরববাসীর সহযোগীতা কামনা করেন তিনি।
জানা গেছে, মৌটুপি গ্রামে সরকার বাড়ির বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা মো. সাফায়েত উল্লাহ ও কর্তা বাড়ির সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এবং বিএনপি নেতা মো. তোফাজ্জল হক গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘ ৫৪ বছর যাবত আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে প্রায় ২০টির মতো খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত ঈদের পর দিন তোফাজ্জল হকের গোষ্ঠীর নাদিম কর্তা সরকার বাড়ির লোকজনের হাতে খুন হয়।
অপরদিকে এই ঘটনার পর ১৩ সেপ্টেম্বর কর্তা বাড়ির লোকজনের হাতে সরকার বাড়ির ইকবাল খুন হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের কয়েকশ বাড়ি ঘর ভাঙচুর লুটপাট হয়েছে। দুটি খুনের ঘটনায় উভয় পক্ষের ২০০ আসামি করে পাল্টাপাল্টি মামলা হয় থানায়। এরই মধ্যে কর্তা বাড়ির নাদিম হত্যা মামলার আসামিরা আদালত থেকে জামিন পেয়ে বাড়িতে চলে আসলেও সরকার বাড়ির ইকবাল হত্যা মামলার আসামিরা জামিন না নিয়ে বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়িতে আসলে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এতে সরকার বাড়ির রমিজ উদ্দিন মিয়ার ছেলে কাইয়ুম মিয়া নিহতসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৫০ জন আহত হন। এদিকে দীর্ঘ ৫৪ বছরে ২০টির মতো খুন হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে প্রায় ২ শতাধিক। এ দুই বংশের একেক পরিবারের একেক জনের নামে অন্ততপক্ষে মামলা রয়েছে ১০ থেকে ১৫টির মতো।
ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ হাসমত উল্লাহ জানান, খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এসময় যৌথ অভিযানে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। নিহত কাইয়ুম মিয়ার মরদেহ সুরতহাল তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য কিশোরগঞ্জ মর্গে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। যৌথ অভিযান ও পুলিশি টহল অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(এসএস/এসপি/নভেম্বর ০২, ২০২৪)