মিতব্যয়িতা মানব চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ ও অমিতব্যয়িতা দারিদ্র্যের একটি প্রধান লক্ষণ
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস’ ২০২৪। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর এই দিবসটি পালন করা হয়। মিতব্যয়ি হওয়ার আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। প্রতিবছর এই দিনে পরিবার ও জাতির কল্যাণে সবাইকে মিত্যব্যয়ি হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। ১৯২৪ সালে ‘মিলানে’ অনুষ্ঠিত বিশ্বের বিভিন্ন সঞ্চয় ব্যাংকের প্রতিনিধিদের প্রথম বিশ্ব কংগ্রেসে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিবসটি পালন শুরু হয়। সেই থেকে সঞ্চয় ব্যাংক সমূহ আন্তর্জাতিক ভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। মূলত মিতব্যয় ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব সর্ম্পকে জনগণের মনোযোগ আর্কষণ করার উদ্দেশ্যে নিয়ে এই দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশেও সরকারিভাবে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয় এবং জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তর এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। দিবসটি উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী-সামজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মিতব্যয়িতা মানে হলো ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযম বা আয় বুঝে ব্যয়। ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনও মিতব্যয়িতার অর্থ। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩০ কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬০ লাখ কোটি টাকা। অথচ বিশ্বে প্রতিদিন ১৭ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ অপচয় করে কোটি কোটি টাকার খাবার। আর এর মাশুল দিতে হয় পথের পাশের মানুষগুলোকে। ১৯২১ সালে সর্বপ্রথম স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রে 'জাতীয় সঞ্চয় দিবস' পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ১৯২৪ সালে ইতালির মিলান শহরে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকের প্রতিনিধি। ২৯টি দেশের প্রতিনিধি বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও দৃঢ় করতে; মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি করতে ও মানুষের মনে সঞ্চয়ের ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সহমত পোষণ করেন। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের শেষ দিনটিকে বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ১৯২৫ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস পালন করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে পালন করা হয় দিবসটি।মিতব্যয়িতা মানব চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ।
অপরদিকে, অমিতব্যয়িতা দারিদ্র্যের একটি প্রধান লক্ষণ। প্রত্যেক ব্যক্তিরই মিতব্যয়ি হওয়া উচিত। জীবনকে সফল করে তোলার জন্য এই বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রয়োজন বিবেচনা করে সম্পদ ব্যয় করা হলে নিজের যেমন কল্যাণ হয়, তেমনি উদ্বৃত্ত সম্পদ দিয়ে জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া যায়। তাই মিতব্যয়িতা ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের জন্য কল্যাণকর। মানুষ সম্পদ অর্জন করে এবং তা সঞ্চয়ও করে। সঞ্চয়ই মানুষের সহজাত প্রবণতা। মানুষ শুধু সম্পদ সঞ্চয়ই করে না, তা ব্যয়ও করে। বস্তুত অর্থ উপার্জন করা হয় ব্যয়ের জন্য, জীবনের নানাবিধ প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ অর্থ ব্যয় করে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রয়েছে কিনা। আয় ও ব্যয়ের দিকটি বিশেষভাবে বিবেচনায় না আনলে, যেমন অর্থ সংকট দেখা দেবে তেমনি দৈনন্দিন জীবনেও অন্তহীন দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হতে হবে। রাজার ভাণ্ডারও একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে শুধু ব্যয়ের পথ খোলা থাকলে। তাই বলা হয় ‘দুই হাতে কুড়াও, এক হাতে ছড়াও’। সুপ্রিয় পাঠক ভাই ও বোনেরা, আয় বুঝে ব্যয় কর’— এই বহুল প্রচলিত প্রবাদটি আপনাদের সবারই জানা। মানুষের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় তার উপার্জিত অর্থ সে কীভাবে ব্যয় করছে, তার মধ্য দিয়ে।সংসারের দাবি মেটাতে গিয়ে আমরা সবাই কম-বেশি বেহিসেবি হয়ে উঠি। আবার অনেকে আছে যারা খরচ করতে গিয়ে কোনো হিসেবই করে না। এই ধরনের প্রবণতা কখনোই জীবনের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। এ জন্যই কবি বলেছেন : ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের ভাতি / আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।’ প্রচুর অর্থও অমিতব্যয়ীদের হাতে নষ্ট হয়ে যায় এবং অতি প্রয়োজনের দিনে হাত শূন্য থাকে।
অমিতব্যয়িতা ব্যক্তিগত জীবনে দুর্গতি টেনে আনে, এবং সামাজিক ও জাতীয় জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। তাই সম্পদ ব্যয় করার সময় ব্যয়ের প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা বিবেচনা করতে হবে। কঠোর শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ হেলাফেলা করে ব্যয় করা উচিত নয়। আর সম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনে সুখ ভোগ করা যায়। জনগণের কল্যাণ করা যায় বলে জীবনে মিতব্যয়িতার বিশেষ প্রয়োজন। মানুষের আয় উপার্জন যে চিরদিন সমান গতিতে হবে এমন আশা করা যায় না। মানুষের জীবনে রয়েছে বাধা-বিপত্তি ও সংঘাত। আমাদের সংসারে দুঃখ আছে, বিপদ আছে, লাঞ্ছনা ও অপমান আছে; এখানে ভয়ের ও বিপদের ভ্রুকুটি আছে, নৈরাশ্যের বেদনা আছে, পরাজয়ের দুঃসহ গ্লানি আছে এবং শোক ও দুঃখের হৃদয়বিদারক আঘাত আছে; এসব জীবনের বৈশিষ্ট্য, জীবনেরই অঙ্গ। হয়ত একসময় আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সঞ্চয় না থাকলে জীবন চালানোই কঠিন হবে।
এ কারণে মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সঞ্চয় পদ্ধতি গড়ে উঠেছে। উদ্বৃত্ত অর্থ সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে- যাতে প্রয়োজনের সময় উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যয় করা যায়। মিতব্যয়িতা মানব জীবনের একটি উত্তম গুণ।
পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো সঞ্চয় দিবস পালনে বিশেষ জোর দিয়ে থাকে। এসব দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে মানুষকে সঞ্চয়ী করে তোলার পেছনে যেমন রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের সুরক্ষিত জীবনের নিশ্চয়তা, তেমনি বিশ্ব অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী ভিত্তিতে গড়ে তোলার প্রয়াস।
তাই আসুন আমরা সকলেই ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয় পরিহার করি।পৃথিবীতে সম্পদহীন, বিত্তহীন লোকের সংখ্যা বেশি। বিত্তহীনদের চিত্তকে প্রফুল্ল করতে, বিকাশ ঘটাতে সম্পদশালীদের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে মিতব্যয়িতার স্বপ্ন আমাদের দেখতেই হবে। কেবল দৈব দুর্বিপাক আর ধর্মীয় অনুশাসনের বাধ্যবাধকতার হিসাবে ঘুরপাক না খেয়ে কল্যাণকর মিতব্যয় জাতির স্বপ্নে বিভোর হওয়াই উত্তম পথ। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগাতে পারলেই অগ্রসর জাতির তকমা সকল মানুষের ললাটে ঝুলবে। অর্থের প্রাচুর্য আর সম্পদের বাহাদুরি থেকে বেরিয়ে আসার পথ উন্মুক্ত হবে। অন্যায়, অবৈধ পথে প্রাণপণে সম্পদ সংগ্রহের অপতৎপরতা রোধ হবে। সম্পদ আর প্রাচুর্য্য জীবনের সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নয়, তা উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে। যদিও অর্থ উপার্জনের প্রবণতা ধনী, গরিব, কাঙ্গাল, ভিখারী সকলের মাঝেই দূরন্ত দুর্বার গতির। এখানে তৃপ্তির বিষয়টি মুখ্য, প্রধান হিসাবে বিবেচনায় আনা হয়। দীন-দরিদ্র, আড়াল-চাড়াল, ভুখা-নাঙ্গারাও অর্থ উপার্জন করে।
অপচয়কারীরা নিজের জন্য তো নয়ই, বরং সমাজ, পরিবার ও জাতির জন্যও কিছু করতে পারে না। বিজ্ঞানী ফ্রাকলিনের এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ছোট ছোট ব্যয় সমদ্ধে সাবধান হও। একটি ছোট ছিদ্র মস্তো বড় জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে পারে’। তাই আজকের মিতব্যয়িতা দিবসে ‘আমরা সবাই সঞ্চয়ী ও মিতব্যয়ী হব; সুন্দর ও সচ্ছল জীবন গড়ে তুলব’- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: সংগঠক,কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।