অমৃতা বিশ্বাস রিয়া


পুরান ঢাকায় স্থাপিত আহসান মঞ্জিল যেমন বহন করে চলেছে হাজার বছরের ইতিহাস ঠিক তেমনই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে অপরূপ এক স্থাপত্য সৌন্দর্যের। ইতিহাস,স্থাপত্য সব মিলে আহসান মঞ্জিল নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও গুরুত্ব বহন করে আসছে।ভবনটি পরিদর্শন করে জানা যায়,মুঘল আমলে ফরিদপুর বরিশাল অঞ্চলের নাম ছিল জামালপুর পরগনা। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফরিদপুরের জমিদার শেখ এনায়েতুল্লাহ পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে রংমহল নামে একটি চমৎকার প্রমোদ ভবন নির্মাণ করেছিলেন। তবে তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ ১৭৪০ সালের দিকে প্রাসাদটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ফরাসিরা রংমহলকে বাণিজ্য কুঠিতে পরিণত করেন।১৮৩০ সালে পুরান ঢাকার বেগম বাজারের জমিদার আলীমুল্লাহের কাছে ফরাসিরা বাড়িটা বিক্রি করে দেন। আলীমুল্লাহের পুত্র নবাব আব্দুল গনি ১৮৬৯ সালে ফরাসি কুঠির পূর্ব দিকে একটি নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৭২ সালে। এবং তার প্রাণপ্রিয় পুত্র আহসানুল্লাহের নামানুসারে প্রাসাদের নামকরণ করেন “আহসান মঞ্জিল”। 

আহসান মঞ্জিলের নির্মাণশৈলী অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং চমকপ্রদ। এই প্রাসাদের গঠনে ইন্দোসারসেনিক অর্থাৎ ভারতীয় এবং ইসলামিক স্থাপত্যের মিশ্রণের প্রভাব দেখা যায়। চমকপ্রদ প্রাসাদটির অভ্যন্তরীণ স্থাপত্যে মুঘল এবং অন্দরমহলের ছাদের নকশা তে ইউরোপীয় রেনেসাঁ শৈলীর নিদর্শন দেখা যায়। বিশেষ করে ধনুকাকৃতির দরজা এবং জানালার ডিজাইনে মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন মেলে। ১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিলে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে এই প্রাসাদটির অন্দরমহল একেবারে ভেঙে পড়ে। এরপর নবাব আহসানুল্লাহ প্রাসাদটি পুনরায় নির্মাণ করেন রংমহলটি মেরামত করান। এ কাজের জন্য রানীগঞ্জ থেকে উন্নতমানের ইট নিয়ে আসা হয়। ভবনটির পুর্ননির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। রংমহলের উপর সুউচ্চ গম্বুজটি পরবর্তীতে নির্মাণ করা হয়। এ গম্বুজ তৈরির জন্য প্রথমে নিচ তলার বর্গাকার কক্ষটির চার কোনায় ইট দিয়ে ভরাট করে গোলাকার রূপ দেয়া হয় এর উপর দোতলায় নির্মিত অনুরূপ গোলাকার কক্ষের অর্ধাংশে স্কুইঞ্জ এর মাধ্যমে ছাদের কাছে কক্ষটিকে অষ্টভুজাকৃতির করা হয়েছে। এ কক্ষটি ছাদের উপর গম্বুজের পিপায় পরিণত হয়েছে। ভূমি থেকে গম্বুজ এর উচ্চতা ২৭.১৩ মিটার। দ্বিতল ভবনটির আয়তন ১২৫. ৪ মিটার × ২৮.৭৫ মিটার। এবং ভবনটি এক মিটার উঁচু বেদীর উপর নির্মিত। নিচ তলার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উচ্চতা ৫ মিটার দোতালার উচ্চতা ৫.৮ মিটার। প্রাসাদটির উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকে একতলার সমান উঁচু বারান্দা রয়েছে।

ভবনের দক্ষিণ দিকের বারান্দার উপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি খোলা সিঁড়ি বাগানের সম্মুখ দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। প্রাসাদের কক্ষের মাঝে মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত প্রাসাদের দেয়াল গুলি প্রায় ০.৭৮ মিটার পুরু। অর্ধবৃত্তাকার খিলানের মাধ্যমে দরজাগুলি স্থাপিত। দরজার পাল্লা গুলিতে নানা রঙের কাজ এবং দরজার বাইরের পাল্লায় কাঠের খড়খড়ি লাগানো আছে। কক্ষপুলির ছাদ কাঠের কড়িবর্গার উপর তৈরি। নবাব বাড়ির কার্পেট গুলো পারস্য থেকে আনা হতো তবে কিছু কিছু ভারতের রাজস্থান থেকে আমদানি করা বলে ধারণা করা হয়। দ্বিতল অন্দরমহলটির তুলনায় রংমহলের উচ্চতা সামান্য বেশি। গম্বুজ কক্ষটি যেন গম্বুজের ভার বহন করতে পারে সেকারণে লোহা ব্যবহৃত হয়েছে। এটি ছিল তৎকালীন ঢাকা শহরের অন্যতম উঁচু চুড়া। প্রাসাদটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে হওয়ায় যাত্রীদের কাছে গম্বুজটি প্রধান আকর্ষণের বিষয় ছিল। গম্বুজ কক্ষের উত্তর পাশের কক্ষটিতে অত্যন্ত চমৎকার কাঠের সিঁড়ি দেখতে পাওয়া যায়। সিড়ি নকশা তে আঙ্গুরলতা সমৃদ্ধ লোহার তৈরি ব্যালাস্টার এবং জ্যামিতিক নকশা সমৃদ্ধ কাঠের সিলিং রয়েছে। এ সিঁড়ি কক্ষে সোনা দিয়ে বাঁধানো একটি ভিজিটর বুক রাখা থাকত। প্রাসাদে আগত সম্মানীয় ব্যক্তিরা তাঁদের মন্তব্য লিখে রেখে যেতেন।

গম্বুজের দুই পাশের ভবনটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। নিচতলার পূর্ব দিকে রয়েছে বিলাসবহুল ডাইনিং রুম। এখানে ৩৮ টি চেয়ার, ৩৪ টি প্লেট, ৬৮ টি গ্লাস এবং প্রতিটি প্লেটের সাথে একটি করে কাঁটা চামচ রয়েছে। এখানে ব্যবহৃত ঝাড়বাতিটি কাটগ্লাসের তৈরি। এখানে নবাব বাড়ির সামাজিক প্রতিপত্তি, আভিজাত্য এবং রুচিশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আহসান মঞ্জিলের হাসপাতাল কক্ষ ছিল ঐ পরিবারের সদস্য এবং কর্মচারীদের চিকিৎসার স্থান। এখান থেকে প্রাপ্ত একটি রেজিস্টার্ড খাতায় দেখা যায় রোগীর সেবা দানের সময় রোগী কোন (caste) সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত তা লিখে রাখা হতো। সামাজিক স্তরায়নের বিষয়টি লক্ষণীয়। নিচতলার পশ্চিমাংশে রয়েছে বৃহৎ দরবার হল। উত্তরের বিলিয়ার্ড কক্ষ অবস্থিত। কক্ষটি রাজকীয়ভাবে সজ্জিত।হরিণের মাথার খুলি দিয়ে সাজানো হয়েছে রুমটি।তবে বিলিয়ার্ড খেলার কক্ষটি শুধু খেলার জন্যই ছিল না বরং এটি ছিল সামাজিক মর্যাদা এবং প্রভাবশীলতার প্রতীক। এখানে গ্রামসির হেজিমনির বিষয়টি লক্ষণীয়। ব্রিটিশদের চিন্তা চেতনা খেলার ছলে বাঙ্গালীদের ভেতর স্থাপন করে দেয়ার বিষয়টি প্রতীয়মান হয়। নবাবরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এবং ব্রিটিশদের খুশি করার জন্য বিলিয়ার্ড কক্ষের ব্যবস্থা করে।

ব্যাপ্তিবাদ অনুসারে বলা হয় সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় উৎপত্তি লাভ করে পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যায় ক্ষমতাসীনদের চর্চার মাধ্যমে ব্রিটেন থেকে বাংলায় ছড়িয়ে গেছে এই বিলিয়ার্ড খেলা।ঢাকার নবাবদের কোষাগার হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষ হল সিন্দুক কক্ষ।বৃহদাকার কাঠের আলমারি এবং সিন্দুক গুলোর মধ্যে সারিবদ্ধ ৯৪টা লকার রয়েছে। (১-৮৬)পর্যন্ত লকারগুলো ছোট এবং (৮৭-৯১)পর্যন্ত লকার গুলো বড়। এখানে সাতটি দরজা দেখতে পাওয়া যায়। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানা যায় যে এ কক্ষে আগুন লাগার ভয় নেই। আলমারির প্রধান তাক খুললে এর পেছনে অনায়াসে একজন মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। অধিকতর নিরাপত্তার বিষয়টি প্রতীয়মান হয় এখানে। এছাড়াও সিন্দুকের পাল্লা চাবি দিয়ে না খুললে তা ভাঙার ব্যবস্থা ছিল। দোতলার পশ্চিম দিকে রয়েছে জলসাঘর, এর উত্তরে হিন্দুস্তানি কক্ষের অবস্থান। হিন্দুস্তানি কক্ষ অন্যান্য অতিথিশালা থেকে ভিন্নভাবে সাজানো। এই কক্ষের সাজসজ্জার প্রধান বিষয় হলো বিভিন্ন গ্রীক মূর্তি, যা মূলত ইউরোপীয় শিল্পের আদলে নির্মিত। এছাড়াও নিখুঁত কারুকাজ মন্ন্ডিত আরামদায়ক সোফা আছে যা রেশম কাপড় দিয়ে মোড়ানো। সোফার সামনে মার্বেল পাথর সহ অন্যান্য পাথরের তৈরি কয়েকটি টেবিল রয়েছে।এই কক্ষ রাজকীয় আতিথিয়েতা, নান্দনিকতা এবং আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে চলেছে। দোতলায় বৃহদাকার ড্রয়িং রুমের উত্তরে লাইব্রেরি কক্ষ এবং কার্ডরুম অবস্থিত। নবাবদের লাইব্রেরী কক্ষ শুধুমাত্র বই সংগ্রহের জন্য ছিল না বরং এখানে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী অতিথিদের সাথে আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে একটি ধাতব পাত্রের ডেস্ক ক্যালেন্ডারের স্ট্যান্ড দেখা যায়। এখানে উর্দু, ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন বই দেখতে পাওয়া যায়। তবে আইন এবং দর্শন শাস্ত্রের উপর সর্বাধিক বই রয়েছে যেমন:Encyclopedia of the Laws of England,The power provinces code in two volume, A DIGEST Of Indian Law Cases।

এ থেকে বোঝা যায় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা এবং প্রজাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি। এই প্রাসাদে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা সভা হয়েছিল। এখান থেকেই ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। ড. মুনতাসির মামুনের “স্মৃতি বিস্তৃতি নগরী” বই থেকে জানা যায়, ঢাকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সুনাম ছিল একসময়। নবাব বাড়ি থেকে পঞ্চায়েত তত্ত্বাবধায়কের পদ সৃষ্টি করে নবাব পরিবারের সদস্য খাজা আজমকে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে তারা সালিশ বসাতেন এই বাড়িতে। আহসান মঞ্জিলে নবাব আহসানুল্লাহের উদ্যোগে কংগ্রেস বিরোধী বহু সভা হয়েছে। ব্রিটিশ লর্ড, ভাইসরয়, গভর্নর এখানে এসেছেন। ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিন এ প্রাসাদে রাত্রি বাস করেন। খাজা সলিমুল্লাহ তার যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এ প্রাসাদ থেকেই পরিচালনা করেছেন। মুসলিম লীগের সূতিকাকার হিসেবে আহসান মঞ্জিল কালের সাক্ষী হয়ে আছে। নবাব আহসানুল্লাহ ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে আহসান মঞ্জিলে ঢাকা শহরের মধ্যে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক আলো জ্বালান। আহসান মঞ্জিলে নবাবদের ব্যবহৃত পানির ফিল্টার রয়েছে। এটি উনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি। এটি ধাতব ট্যাব যুক্ত, উচ্চতা ৪২ সে.মি.।

১৮৭১ সালে নবাব আব্দুল গনি প্রিন্স অফ ওয়েলসের রোগ মুক্তির জন্য পানির ফিল্টার বসানোর মনস্থ করেন। ১৮৭৪ সালের ৬ আগস্ট ভাইসরয় লর্ড লর্ড নর্থব্রুক পানির কলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। নবাব আব্দুল গনি তৎকালীন আড়াই লক্ষ টাকা ব্যয় করে এই পানির কল স্থাপন করেন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছেন ক্ষমতাকে একটি শোষণ মূলক ব্যবস্থা হিসেবে নয় বরং উৎপাদনশীল শক্তি হিসেবে দেখা হয়। ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্র বা শাসন ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি সামাজিক সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত। নবাব আব্দুল গনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এবং ব্রিটিশদের সুবিধার্থে ফিল্টার স্থাপন করলেও শহরের বহু মানুষ কলেরা, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলী এবং নৃবিজ্ঞানকে একসঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে আমরা ঐ সময়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার কাঠামোকে বুঝতে পারি। নৃবিজ্ঞান মূলত মানবসমাজ, সংস্কৃতি এবং তাদের পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করে। এটি কেবল একটি স্থাপত্যিক ধারণা নয় বরং নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলন এবং সেই সময়ের উপনিবেশিক প্রভাবের প্রতিনিধিত্ব করে। আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন করে, বিভিন্ন বই, জার্নাল এবং স্থানীয় মানুষদের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আহসান মঞ্জিলের যেমন ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্যের দিক রয়েছে একই সাথে এর নৃতাত্ত্বিক গুরুত্বও কম নয়।

লেখক : প্রতিনিধি এমএসএস, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।