ডা. মুহাম্মাদ হতাব হোসাইন মাজেদ


আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ব উন্নয়ন তথ্য দিবস ২০২৪। জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৭২ সাল থেকে প্রতি বছরের ২৪ অক্টোবর এ দিনটি বৈশ্বিকভাবে পালিত হয়ে আসছে।উন্নয়নের পথে অন্তরায় সমস্যাগুলোর সমাধানে বিশ্বজনতার মতামত বিবেচনা করা বিশ্ব উন্নয়ন তথ্য দিবসের লক্ষ্য। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মজবুত করাও দিবসটির উদ্দেশ্য।তবে এই দিবস ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়নে সমস্যাবলী ও এর সমাধানের নিমিত্তে আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।অন্যদিকে জাতিসংঘ নীতিগতভাবে জাতিসংঘ দিবসকেই উন্নয়ন তথ্য দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে, কারণ ১৯৭০ সালের ২০ অক্টোবরই জাতিসংঘ ২য় উন্নয়ন দশকের জন্য আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন কৌশল গৃহীত হয়।

সাধারণ অধিবেশনের উপলদ্ধি এই যে, সর্বত্র বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে তথ্য প্রচার, জনমত সৃষ্টি, উন্নয়ন সমস্যা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং উন্নয়ন সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করবে।

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী অস্ত্র সংঘাতের ভয়াবহতা ও বেদনাময় স্মৃতির প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংকল্পের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতিসংঘের বেশির ভাগ কার্যক্রম বিস্তৃত। অনেকের-ই ভুল ধারণা আছে যে, জাতিসংঘ শুধু শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত। অথচ আজকের দিনে জাতিসংঘের অধিকাংশ তৎপরতা উন্নয়ন ও মানবিক সহযোগিতার কাজেও নিবেদিত। পৃথিবীর প্রায় ১৩৫টি দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জাতিসংঘ প্রতি বছর আড়াই হাজার কোটি ডলারেরও বেশি তহবিল জুগিয়ে থাকে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী। আর তাই জাতিসংঘের বেশির ভাগ কাজ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। কেননা, এসব দেশের মানুষ অভাব-অনটন, ক্ষুধা, অশিক্ষা, রোগ-শোক ইত্যাদি ঝামেলার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে।

জন্মলগ্ন থেকেই জাতিসংঘ তার সনদের ৫৫ ধারার অর্থাৎ উচ্চমানের জীবনযাপন নিশ্চিত করা, বেকার সমস্যা দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। জাতিসংঘ সহায়তা করে এসেছে গরিব দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশসমূহের সাহায্যে নেওয়া বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও কার্যক্রম তুলে ধরার জন্য সাধারণ পরিষদ পর পর চারটি জাতিসংঘ উন্নয়ন দশকের কথা ঘোষণা করেছে। ষাটের দশকের শুরু থেকে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ উন্নয়ন প্রসারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। এই উন্নয়ন প্রয়াস আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিফলিত হয় ১৯৬৯ সালে, সমাজ প্রগতি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গে দেওয়া সাধারণ পরিষদের ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

এই ঘোষণায় বলা হয়, সবার জন্য কাজ করার অধিকার নিশ্চিত করা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং সম্মিলিতভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উৎপাদনশীল কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা, বেকার সমস্যা দূরীকরণ ও চাকরির মানোন্নয়ন, সবার জন্য কাজের সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা, স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা ও নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা কোনো ধরনের ভেদাভেদ ছাড়া শ্রমের ন্যায়সংগত পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা প্রভৃতি। জাতিসংঘের ঘোষিত প্রথম উন্নয়ন দশক ছিল ১৯৬১-১৯৭০। দ্বিতীয় দশক ঘোষণা করা হয় ১৯৭০-১৯৮০। দ্বিতীয় দশকের উন্নয়ন পরিকল্পনা ছিল ন্যায়পরায়ণতা ও সমতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিমূল সমতা, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, অভিন্ন স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে রাষ্ট্রে সহযোগিতা যা নির্মূল করবে অসমতা অন্যায়, দূর করবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ব্যবধান।আমরা জানি যে তথ্যের আবদ্ধতায় জনসাধারণ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে একটি দেশের উন্নয়ন। নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য একটি দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। এটি দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া সব দেশেই কার্যকর তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজন রয়েছে। এ অধিকার ছাড়া আইনি বাধা পেরিয়ে সব তথ্য জনসাধারণের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

অবাধ তথ্যপ্রবাহের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাও বিস্তৃত হওয়া জরুরি।তাই তথ্য প্রাপ্তি, ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও বিতরণে আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত।জাতিসংঘ সর্ম্পকিত যাবতীয় তথ্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে পৌচ্ছে দেওয়াই এই দিবসটি পালনের মূল কারণ।পৃথিবীতে পদার্পণের পর থেকেই মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে ও জীবনমান উন্নয়নের জন্যে সচেষ্ট হয়েছে ৷ এ পৃথিবীকে বশীভূত করার ও প্রকৃতিকে জয় করে একে মানুষের কল্যাণে আরো ভালোভাবে ব্যবহার করার লক্ষ্যেই কৃষি ও শিল্প-বিপ্লবগুলো সংঘটিত হয়েছিল ৷ বর্তমানে উন্নয়নে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এমন সব দেশ বা স্বল্পন্নোত দেশগুলোতে উন্নয়ন নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে৷ আজকাল উন্নয়ন বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতিমালার মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু উন্নয়ন বলতে কি বোঝায় এবং কোন কোন মানদন্ড বা দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে তা খুব দ্রুত অর্জন করা সম্ভব?

উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতি- এ শব্দগুলো প্রায়ই বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংক্রান্ত লেখালেখি বা আলোচনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ অধিকাংশ অর্থনৈতিক গবেষণায় এ শব্দগুলো অনেকটা সমার্থক শব্দ হিসেবে পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়৷ প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন এ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বলে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন৷ প্রবৃদ্ধি বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক ও পরিমাণগত কিছু চালিকাশক্তি বা মানদন্ডকে বোঝানো হয়৷ যেমন, মাথাপিছু আয়, গড় জাতীয় আয় বা উৎপাদন ইত্যাদি৷ অন্যদিকে উন্নয়ন বলতে এইসব অর্থনৈতিক সূচকের অবস্থা বিবেচনার পাশাপাশি অবকাঠামোগত পরিবর্তনকেও বিবেচনা করা হয়৷ অন্য কথায় উন্নয়নের পরিধি আরো ব্যাপক এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ার রয়েছে বহুমাত্রিক দিক বা বিভাগ৷

একদল অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সম্পদের সুষম ও ন্যায্য বন্টন, দারিদ্র বিমোচন, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, কাঙিখত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং জনকল্যাণ-এসবই হলো উন্নয়নের প্রধান কিছু সূচক৷ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মাইকেল টডারো বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো সমাজের সকল স্তরের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন৷ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবাদে এই উন্নতি ঘটে থাকে।আমরা জানি যে তথ্যের আবদ্ধতায় জনসাধারণ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে একটি দেশের উন্নয়ন। নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য একটি দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে।

এটি দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া সব দেশেই কার্যকর তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজন রয়েছে। এ অধিকার ছাড়া আইনি বাধা পেরিয়ে সব তথ্য জনসাধারণের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাও বিস্তৃত হওয়া জরুরি।তাই তথ্য প্রাপ্তি, ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও বিতরণে আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। জাতিসংঘ সর্ম্পকিত যাবতীয় তথ্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে পৌচ্ছে দেওয়াই এই দিবসটি পালনের মূল কারণ।

যে কোন রাষ্ট্রকে উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যেতে হলে সরকার প্রধানের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেতার কাজ হচ্ছে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া। নেতার যদি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে দেশ সঠিকভাবে কখনোই এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামীর প্রযুক্তি বিপ্লবে নেতৃত্বের আসনেই থাকবে বাংলাদেশ। তাই মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা মারাত্মক অন্যায়। মিথ্যা কথা বলে তথ্য প্রকাশ করা ইসলাম নিষেধ করছে। একটি তথ্য উপস্থাপন করতে হলে অবশ্যই সুন্দর, সাবলীল, যুগোপযোগী মিষ্টি ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে।

লেখক: কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।