নিভারাণী সান্যাল


দেবেশ চন্দ্র সান্যাল একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার শাজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নাধীন রতন কান্দি গ্রামে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের “অপারেশন সার্চ লাইট” শুরু হলে বাঙালি সৈন্য, পুলিশ, ইপিআর ও অন্যান্যরা প্রথমে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। ২৬ মার্চ’৭১ মধ্য রাতের পর থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ২৬ মার্চ’৭১ এর পর পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে বসে। তারা নির্বিচারে, হত্যা, গণহত্যা, জ্বালাও, পোড়াও, ধর্ষণ, নিপিড়ন ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী নৃশংসতম কাজ করে। জীবন বাঁচাতে দেশের বিভিন্ন নরনারী ভারতে আশ্রয় নেয়। বাঙালি আর্মি, ই.পি.আর.ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যগণ মুক্তিফৌজে ও কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও অন্যান্য নর-নারী বাংলাদেশ কে হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। 

বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ হীণ কৃষক শ্রমিক, ছাত্র ও অন্যান্যরাও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে বা না নিয়ে মুক্তি বাহিনী/গন বাহিনীতে যোগ দেয়। অস্ত্র ও গোলা বারুদের স্বল্পতার কারণে অনেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ও গোলা বারুদের জন্য ভারতে চলে যায়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানি সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত এম.এন.এ ও এম.পি এ দের কে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১০ এপ্রিল’৭১ ভারতের পশ্চিম বঙ্গে স্বাধীন সার্বভৌম গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল’৭১ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়ার বৈদ্যনাথ তলায় গন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বৈদ্যনাথ তলাকে মুজিব নগর নাম করণ করা হয়।

মুজিব নগর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়। দেশের ক্রান্তি কালে কিশোর দেবেশ চন্দ্র সান্যাল জীবন পণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে ছিলেন। তিনি তাঁর বাবা মা ও বাড়ির অন্যান্য কাউকে না জানিয়ে সাথী অন্যান্যদের সাথে ভারতে যান। তিনি ভারতে মুুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। তিনি ৭ নম্বর সেক্টরাধীন দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানি ঘাটা নামক ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষনের পর তাঁদেরকে পানি ঘাটা থেকে নিয়ে আসা হয় ৭ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার কালিয়াগঞ্জ থানার তরঙ্গপুর।

তরঙ্গপুর থেকে এলাকার আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গেরিলা গ্রুপ করা হয়। অস্ত্র ও গোলা বারুদ দেওয়া হয়। দেবেশ চন্দ্র সান্যাল এর নামে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, একটি বেয়নেট ও এক ম্যাগজিন সহ কিছু গুলি ইস্যু করা হয়। অন্যান্য গোলা বারুদ, গেনেট, এক্সপ্লোসিভ ও অন্যান্যা সামগ্রী তাঁর কমান্ডার কে বুঝিয়ে দেওয়া হয়ে ছিল। তাঁর গ্রুপ কমান্ডার নিযুক্ত হন সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার (বর্তমানে উপজেলা) তামাই গ্রামের জনাব গাজী আব্দুৃল মান্নান। তাঁরা সবাই গ্রুপ নিয়ে চলে আসেন। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানায় (বতর্মানে উপজেলা)। দেশের অভ্যন্তরে এলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা অনেকে তাদের গ্রুপে যোগদান করেন। তাঁদের গ্রুপটি বড় হয়ে পড়ে। তখন গ্রুপ কমান্ডার জনাব গাজী আব্দুল মান্নান ডেপুটি লিডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী কে কমান্ডার করে আর একটি গ্রুপ তৈরী করেদেন। দেবেশ চন্দ্র সান্যাল কে সংযুক্ত করা হয়। শাহজাদপুর থানার (বর্তমানে উপজেলা) জামিরতা গ্রামের রবীন্দ্র নাথ বাগচীর গ্রুপে।

দেবেশ চন্দ্র সান্যাল দুই জন কমান্ডারের অধীনে ৪টি ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান এর নেতৃত্বাধীন হয়ে (১) সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানা আক্রমন যুদ্ধ ও (২) সিরাজগঞ্জ সদর থানার কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন এ্যাম্বুস। ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত) রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর নেতৃত্বে (১) সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার কল্যানপুর যুদ্ধ ও (২) শাহজাদপুর থানার (বর্তমানে উপজেলা)সোনাতনী ইউনিয়াধীন ধীতপুর নামক ওয়াপদা বাধের যুদ্ধে। ধীতপুর যুদ্ধ টি ছিল প্রশিক্ষন প্রাপ্ত পেশাজীবি পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তাঁদের পক্ষের দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা (১) বেড়া থানার বৃশালিখা গ্রামের শহিদ মো: আব্দুল খানেক ও (২) ছেচাানিয়া গ্রামের(বর্তমান আফতাব নগর) (৩) শহিদ মো: আমজাদ হোসেন শহিদ হয়েছেন এবং তাঁদের গ্রুপে ও সহযোগি অন্যান্য গ্রুপেরর কয়েক জন্য আহত হয়ে ছিলেন।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ঘরনী ও কথা সাহিত্যিক।