মো: আল-আমিন, শ্রীমঙ্গল : বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। কিন্তু সম্প্রতি এখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এক অসাধারণ মানুষ ১১৯ বছর বয়সী রাম সিং। তাঁর দীর্ঘ জীবন, সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতা যেন এক জীবন্ত ইতিহাস, যা শুধু এই অঞ্চলের মানুষ নয়, গোটা দেশের জন্যই বিরল ও স্মরণীয়। 

শ্রীমঙ্গলে শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম মেকানীছড়া। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তঘেঁষা এই গ্রাম ঘুরলে অন্য এলাকার চেয়ে বয়স্ক মানুষ একটু বেশিই চোখ পড়ে। তাঁদের সবার মধ্যে প্রবীণ মানুষটির নাম রাম সিং গড়। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বলছে, রাম সিংয়ের বয়স ১১৯ পেরিয়েছে। তবে গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী রাম সিংয়ের বয়স ১১৯ বছর হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর বয়স আরও বেশি হবে। সঠিকভাবে যাচাই–বাছাই করে আবেদন করলে তিনি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষের স্বীকৃতি পেতে পারেন। এই বয়সেও তিনি দিব্যি চলাফেরা করছেন। বাড়ির ছোটখাটো কাজ নিজ হাতেই করছেন। চশমা ছাড়াই বই পড়তে পারেন।

জাতীয় পরিচয়পত্রে রাম সিং গড়ের জন্মতারিখ ১৯০৫ সালের ৬ আগস্ট। তাঁর বাবার নাম বুগুরাম গড় ও মায়ের নাম কুন্তী গড়।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির (জীবিত) স্বীকৃতি পেয়েছেন জাপানের তমিকো ইতোকা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর বয়স ছিল ১১৬ বছর ১১৬ দিন। এখন অবধি সবচেয়ে বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচার রেকর্ডটি ফ্রান্সের নাগরিক জেন লুইস ক্যালমনের। তিনি ১৮৭৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ১২২ বছর ১৬৬ দিন বেঁচে ছিলেন।

মেকানীছড়া গ্রামের বৃদ্ধা সরস্বতী গড়ের বয়স এখন ৮০ বছর। তিনি বলেন, ‘আমি যখন এই এলাকায় বিয়ে করে আসি, তখন রাম সিং গড়ের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই বছর আগে ওনার মেয়ে মারা যান। মেয়ের বয়সও আশির বেশি হবে। তিনি আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক লোক। এখন অনেক কিছু ভুলে যান, তবে একসময় সব ইতিহাস আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনতাম।

রাম সিংয়ের পূর্বপুরুষেরা চা চাষের জন্য ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারত থেকে এই অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলেন। রাম সিং প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়, তখন তিনি হরিণছড়া চা–বাগানের চৌকিদার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও তিনি চা-বাগানেই কাজ করতেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রদের মারা যাওয়ার খবর তখন তিনি শুনেছিলেন। ১৯৬৫ শ্রীমঙ্গল বিদ্যাবিল চা–বাগানে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তিন থেকে চার দিনের যুদ্ধ হয়েছিল। গোলাগুলি হয়েছিল। তখন তিনি বিদ্যাবিল চা–বাগানে ছিলেন। সেখান থেকে সরে আসেন পুটিয়া চা–বাগানের দিকে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হরিণছড়া চা–বাগানের ব্যবস্থাপক ও কর্মীরা পালিয়ে যান। কিন্তু তিনি পালাননি। তিনি ও হরিণছড়া চা-বাগানের শ্রমিক নীরেন হাদিমা মিলে শ্রমিক সংগ্রহ করে চা–পাতা তুলে খেজুরি চা–বাগানে পাঠান। পুরো ৯ মাস বাগানে থেকে হরিণছড়া চা–বাগান রক্ষা করেন।

রাম সিংয়ের বর্ণনায় পুরোনো শ্রীমঙ্গল শহরের একটি বর্ণনা পাওয়া গেল। তিনি বলেন, তিনি শ্রীমঙ্গলের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তখন ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের এক পাশে পাকা ঘর ছিল, আরেক পাশে ছিল শণের ঘর। এই শণের ঘরেই তিনি ক্লাস করতেন। তখন তিনি মৌলভীবাজার সড়কের কোনো এক আচার্যের বাড়িতে থেকে পড়তেন। এ সময় শ্রীমঙ্গলে পাকা সড়ক হয়নি। তাঁর ভাষ্যমতে, পাকা ঘর বলতে শ্রীমঙ্গল পুরোনো বাজারে একটি ত্রিপুরা রাজ্য ব্যাংক, রামরতন বানিয়ার বাসা ও জগন্নাথ জিউর আখড়ার পশ্চিমে ত্রিপুরা রাজার বাংলো ছিল। মাঝেমধ্যে ত্রিপুরার রাজা হাতির পিঠে চড়ে এই বাংলোয় এসে থাকতেন এবং এখান থেকে খাজনা আদায় করতেন।

রাম সিং মনে করেন, তাঁর বয়স ১৩০ বছরের ওপরে হবে। তিনি বলেন, প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ৬৫ থেকে ৬৬ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই সংসারে তাঁর পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে জন্ম নেয়। আগের সংসারে শুধু একটি মেয়ে ছিল। আগের সংসারের মেয়ে ও পরের সংসারের বড় ছেলে ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। ছেলেমেয়েরা একাধিক নাতনির বিয়ে দিয়েছেন। নাতি-নাতনির সন্তানেরাও এখন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছেন।

হরিণছড়া চা–বাগানের শ্রমিক নীরেন হাদিমার বয়সও ৮০ পেরিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যুবক বয়সে যখন রাম সিংয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়, তখন তিনি আমার বয়সের তিন গুণ বড় ছিলেন। আমরা একসঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। রাম সিংয়ের বয়স ১৩০–এর কাছাকাছি হবে।’

শ্রীমঙ্গল উপজেলা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম বলেন, রাম সিং গড়ের তথ্য জানতে পেরে তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। পরে যাচাই-বাছাই করে সত্যতা পান। স্থানীয় অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, রাম সিংয়ের বয়স জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ১১৯ বছর হলেও প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি হবে। তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানিয়েছেন। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাঁর সব তথ্য পাঠানো হবে। আশা করছেন, সারা বিশ্বে তিনি সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।

শ্রীমঙ্গলের ইউএনও মো. আবু তালেব বলেন, রাম সিংয়ের বিষয়ে জানার পর সমাজসেবা কর্মকর্তাকে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। সব তথ্য–উপাত্ত নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া হবে। এরপর নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অনেক দিন আগেই বয়স ১০০ পার হলেও এখনো নানা কাজ করতে পারেন রাম সিং গড়।

তাঁর ছেলে জগদীশ গড় বলেন, তাঁর বাবা বাড়িতে বসে বসে বাঁশ ও বেত দিয়ে হাতপাখাসহ নানা জিনিস বানান। রান্নার জন্য শুকনা কাঠ সংগ্রহ করেন। এই বয়সে এসেও তিনি প্রতিদিন প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করেন। কানে কিছুটা কম শোনেন, তবু লোকজনের সঙ্গে গল্প করতে বিভিন্ন বাড়িতেও যান।

(এএ/এসপি/অক্টোবর ১৯, ২০২৪)