দিনাজপুরে মামলা দিয়ে অর্থ বাণিজ্য
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : দিনাজপুরে কেউ কেউ বাণিজ্য শুরু করেছে, হত্যা-হামলা, মারপিট, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মামলা দিয়ে। হত্যা, মারপিট, লুটপাট, চাঁদাবাজির ঘটনায় জেলার বিভিন্ন থানায় এ পর্যন্ত ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ঘটনায় হত্যা মামলা ৫টি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও চাঁদাবাজি বিষয়ক মামলা ৮টি এবং ৬টি আগের ঘটনায় করা হয়েছে মামলা। এসব মামলার এজাহারে ৮৫১ জনকে এবং অজ্ঞাতনামা করা হয়েছে ৪ হাজার ১৫ জনকে আসামি। গত রবিবার (১৩ অক্টোবর) পর্যন্ত পুলিশ এজাহারভুক্ত ১২ জন এবং সন্দেহভাজন ১৩ জনকে এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।
গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় রবিউল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ হত্যা ঘটনায় পৃথকভাবে ৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় বাদী রবিউলের ভাই। বাকি মামলাগুলোর বাদীর সঙ্গে নিহত রবিউলের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। এই বাদীদেরই নিহত রবিউলের পরিবারের সদস্যরাও চেনেন না। বর্তমানে কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে আসামির নাম বাদ দেওয়ার বাণিজ্য শুরু করেছেন। আর এই কাজ করা হচ্ছে হলফনামার (অ্যাফিডেভিট) মাধ্যমে। এর সঙ্গে যোগসাজশ আছে কথিত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও। এমন অভিযোগ এখন সর্বত্র টক অব দ্যা টাউনে পরিনত হয়েছে।
রবিউল হত্যার ঘটনায় হওয়া একটি মামলার বাদী রিয়াদ হোসেন নামের এক যুবক। আন্দোলনে তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি ১০৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৬০০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন,দিনাজপুর কোতয়ালী থানায়। এই মামলায় আসামি মজিবর রহমান (৫৬) নামের এক ব্যক্তি। গত ২৯ আগস্ট মামলার বাদী রিয়াদ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার হলফনামা করেন। মামলার এজাহার থেকে যেন নিজের নাম বাদ দেওয়া হয়, সে জন্য হলফনামার একটি কপি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দেন মজিবর।
আসামি মজিবর রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, ‘কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিংয়ে আমি যাইনি। এরপরও আমার নাম দিয়েছে। আমার মামলার বাদী যিনি, উনি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, তুমি তো আমাকে চেনো না। তাহলে আমার নাম দিলে কেন?” সে বলল, “কে জানি তাঁকে দিতে বলেছে।” আমি হার্টের (হৃদ্রোগ) রোগী। এই বয়সে আমাকে হয়রানি করতেছে। বিগত সরকারের আমলেও কারণ ছাড়াই আমার নামে তিনটি নাশকতা মামলা দিয়েছিল।’
আসামিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে মামলার বাদী মো. রিয়াদের মুঠোফোন নম্বরে ফোন দেওয়া হয়। যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দিনাজপুরের বিভিন্ন থানায় মারধর, হত্যা, লুটপাট, চাঁদাবাজির ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় ভাঙচুর, লুটপাট ও চাঁদাবাজিবিষয়ক মামলা আটটি, হত্যার ঘটনায় পাঁচটি এবং ছয়টি আগের ঘটনায় করা মামলা। এসব মামলার এজাহারে ৮৫১ জনকে এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৪ হাজার ১৫ জনকে। গত রোববার পর্যন্ত পুলিশ এজাহারভুক্ত ১২ জন এবং সন্দেহভাজন ১৩ জনকে এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।
থানায় ও আদালতে মামলা করার পর থেকে শুরু হয় এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার নামে ‘হলফনামা বাণিজ্য’। মজিবরের মতো অনেকেই বাদী কিংবা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে এজাহার থেকে নাম বাদ দিতে হলফনামা তৈরি করে জমা দিচ্ছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রোববার (১৩ অক্টোবর) পর্যন্ত এসব মামলার বাদীরা এজাহারে প্রায় ৪০ জন আসামিকে হলফনামা করে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আসামির কাছে বাদীরা সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা উপঢৌকন (ঘুষ) নিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে বাদীরা হলফনামায় লিখে দিচ্ছেন, ঘটনার সঙ্গে আসামির জড়িত না থাকার কথা কিংবা অজ্ঞতাবশত,অসুস্থতার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম এজাহারে যুক্ত করার কথা। একটি শর্তে উল্লেখ থাকছে মোকদ্দমা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জামিন, অব্যাহতি কিংবা খালাস পেলে বাদীর কোনো আপত্তি না থাকার কথা।
আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হলফনামা খুব বেশি জোরালো ভূমিকা রাখে না। এ বিষয়ে দিনাজপুর আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সভাপতি প্রবীন আইনজীবী এডভোকেট একরামুল আমীন বলেছেন ‘শুনতেছি, অনেকেই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাফিডেভিট করছেন। এতে খুব একটা লাভ হবে না। কারণ, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি ঘটনার সঙ্গে ওই ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পান, সে ক্ষেত্রে তিনি তো তাঁকে অব্যাহতি দেবেন না। আইন অনুযায়ী বাদী আদালতে উপস্থিত হয়ে জবানবন্দি দিলে আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।’
তার মতে, মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করছে, আর এই সুযোগটাই হয়তো কেউ কাজে লাগিয়ে অর্থ বাণিজ্যে নেমেছেন। যা অত্যন্ত দু:জনক ও বে-আইনী কর্মকান্ড।'
(এসএস/এসপি/অক্টোবর ১৬, ২০২৪)