ওয়াজেদুর রহমান কনক


শিক্ষার বিবর্তন মানব সভ্যতার সাথে গভীরভাবে জড়িত। এর বিকাশকে বিভিন্ন যুগে ভাগ করে দেখা যায়, যেখানে শিক্ষা প্রাথমিকভাবে মৌখিক প্রথা থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে রূপান্তরিত হয়েছে। শিক্ষার বিবর্তনের এই ধারা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে।

প্রাচীন যুগে শিক্ষা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে ছিল না। শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন। মানুষ এ সময় মৌখিকভাবে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা শিখতো। শিক্ষা পরিবার এবং সম্প্রদায়ের প্রবীণদের কাছ থেকে শেখানো হতো। এর মধ্যে শিকার, কৃষি, এবং হস্তশিল্প শেখানো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোনো লিখিত ভাষা ছিল না, তাই মুখে মুখেই শেখা এবং শেখানোর প্রক্রিয়া চলতো।

প্রাচীন সভ্যতার শিক্ষা (Ancient Civilization Education):
প্রাচীন সভ্যতায় লিখন ব্যবস্থার আবিষ্কার শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময়ে শিক্ষা ধীরে ধীরে ধর্মীয়, প্রশাসনিক, এবং সামরিক জ্ঞান কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।

মেসোপটেমিয়ায় লিখন প্রবর্তনের ফলে প্রশাসনিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রচলন হয়। এখানকার শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় অনুশাসন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা শেখানো।

মিশরে শিক্ষার বিকাশ ঘটে ধর্মীয় এবং প্রশাসনিক কাজে। পিরামিডের নির্মাণকাজ ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য গণিত এবং লেখার জ্ঞান শেখানো হতো।

গ্রিসে শিক্ষা ছিল স্বাধীন চিন্তা এবং যুক্তি কেন্দ্রিক। প্লেটো, সোক্রেটিস, এবং অ্যারিস্টটল শিক্ষার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন। রোমানরা গ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং প্রশাসনিক ও আইনি শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়।

প্রাচীন ভারতে শিক্ষা ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে ছিল। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় শিক্ষার প্রচলন ছিল, যেখানে ঋগ্বেদ, উপনিষদ এবং অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থ শিক্ষা দেওয়া হতো।

মধ্যযুগে শিক্ষার কেন্দ্র ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। খ্রিস্টান চার্চ, মসজিদ, এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শিক্ষা পরিচালনা করত।

মধ্যযুগে ইউরোপে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় বিধান শেখানো। মঠ এবং ক্যাথেড্রালে ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ল্যাটিন ভাষা এবং আইনি শিক্ষাও দেওয়া হতো।

ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় বাগদাদে বাইতুল হিকমা (House of Wisdom) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসা, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর গবেষণা এবং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

১৪শ থেকে ১৭শ শতাব্দীতে ইউরোপে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের মাধ্যমে শিক্ষায় এক বিপ্লব ঘটে। মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, বিজ্ঞান এবং যুক্তির ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার নতুন ধারা শুরু হয়। কপর্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন প্রমুখ বিজ্ঞানীদের কাজ শিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

শিক্ষার মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য, এবং দর্শন পড়ানো হতো। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এবং স্বাধীন চিন্তা শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

১৮শ এবং ১৯শ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর শিক্ষার চাহিদা ও গতি বাড়তে থাকে। এ সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার গুরুত্ব বেড়ে যায়।

অনেক দেশেই উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষাকে সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে এনে তা ব্যাপকভাবে প্রসারিত করা হয়।

শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়, এবং সাধারণ জনগণের জন্য শিক্ষা সহজলভ্য হয়। গণশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাকে গণতান্ত্রিক ধাঁচে পরিচালনা করা শুরু হয়।

বর্তমান যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতি শিক্ষার ধারা পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিয়েছে। ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উদ্ভাবন শিক্ষাকে বিশ্বব্যাপী আরও সহজলভ্য করে তুলেছে।

ই-লার্নিং, অনলাইন কোর্স এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটে। Coursera, Udemy, edX-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত জ্ঞান ভাগাভাগির নতুন পথ খুলে দেয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং শিক্ষার নতুন দিগন্ত: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহার শিক্ষাকে আরও ব্যক্তিগতকৃত এবং স্বয়ংক্রিয় করে তুলছে। মেশিন লার্নিং এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী পাঠ্যক্রম তৈরি করতে সহায়তা করছে।

শিক্ষার বিবর্তন একটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, যা মানবজাতির চিন্তা-চেতনার অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়েছে। প্রতিটি যুগে শিক্ষার ধরন এবং লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন পদ্ধতির আবির্ভাব হবে।

শিক্ষা মানবজীবনের অন্যতম মৌলিক ও প্রয়োজনীয় উপাদান। এটি মানুষের ব্যক্তিগত উন্নয়ন, সমাজের অগ্রগতি এবং জাতীয় অগ্রযাত্রার মূল চালিকা শক্তি। শিক্ষার বিবর্তন এক দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়া, যা মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার ধরণ ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে, যা যুগে যুগে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও জীবনধারার প্রতিফলন।

শিক্ষার ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে, মানুষের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্য দিয়ে শেখানোর প্রথা চালু ছিল। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা, শিকার, কৃষিকাজ এবং হস্তশিল্প শেখাতো মুখে মুখে। এই সময়ে লিখিত ভাষার অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার সবকিছুই ছিল মৌখিক। প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে শিক্ষার বিকাশ ঘটে ধীরে ধীরে, মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রিস এবং ভারতের মতো সভ্যতাগুলোতে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হতে থাকে।

মধ্যযুগে শিক্ষার কেন্দ্রীয় স্থান ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। ইউরোপে খ্রিস্টান মঠ এবং ক্যাথেড্রালগুলো শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র ছিল, যেখানে ধর্মীয় পাঠদানের পাশাপাশি ল্যাটিন ভাষা ও আইনি শিক্ষাও দেওয়া হতো। এদিকে, ইসলামিক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা বাগদাদের ‘বাইতুল হিকমা’ (House of Wisdom)-তে বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন ও চিকিৎসার উপর প্রচুর গবেষণা পরিচালনা করত। এই সময়ে ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব ছিল সর্বাধিক, যা সমাজের সবস্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৪শ থেকে ১৭শ শতাব্দীতে রেনেসাঁর মাধ্যমে ইউরোপে শিক্ষায় এক বিপ্লব ঘটে। বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, এবং স্বাধীন চিন্তা শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতো দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনা শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কপর্নিকাস এবং গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীরা শিক্ষাকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যান। মধ্যযুগের ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষায় যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

১৮শ এবং ১৯শ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় এবং সাধারণ জনগণের জন্য শিক্ষাকে সহজলভ্য করা হয়। গণশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার গণতন্ত্রায়ন ঘটে। বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোবদ্ধ রূপ গড়ে ওঠে, যা আজকের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করেছে।

বর্তমান যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে শিক্ষার পদ্ধতিতেও এক বিশাল পরিবর্তন এসেছে। ইন্টারনেট, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই জ্ঞানের সমুদ্র থেকে নিজের প্রয়োজনমতো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। Coursera, Udemy, Khan Academy-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার প্রসার ও সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং-এর মতো প্রযুক্তি শিক্ষাকে ব্যক্তিগতকৃত এবং আরও কার্যকরী করে তুলেছে।

শিক্ষার বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা মানবজাতির চিন্তা-চেতনা এবং প্রগতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রতিটি যুগে শিক্ষার ধরণ, লক্ষ্য এবং প্রভাব পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য — জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধ অর্জন—আজও অপরিবর্তিত। শিক্ষার এই অগ্রযাত্রা মানবসভ্যতাকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যতেও এর প্রসার অব্যাহত থাকবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী