ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার।’ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে কর্মস্থল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রতিপাদ্য কে সামনে রেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হয় এর সাথে সাথে বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হচ্ছে। ১৯৯২ সাল থেকে সারা পৃথিবীতে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন রকম কর্মসূচি পালন করা হয়।

কিছু কিছু দেশে একে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসেবে পালন করে থাকে। বিশ্বে আত্মহত্যা করার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। আত্মহত্যার প্রধান কারণ হচ্ছে মানসিক সমস্যা সাধারণত যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আত্মহত্যা করার হার কমিয়ে আনা সম্ভব।

মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারি সুপরিকল্পিত নীতিমালা চিকিৎসা স্বাস্থ্যকর্মী কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী। যার ফলে দেশের মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য এর ওপর সচেতন করা হয়। শরীর এবং মন এ দুই নিয়ে হচ্ছে মানুষ। শরীরবিহীন যেমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি মনবিহীন মানুষও অসম্ভব। সুস্থ-সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে গেলে সুস্থ শরীর এবং সুস্থ মন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

মানসিক অসুস্থতার ধরণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করছে যেটা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন।দেহ আর মন মিলেই মানুষ। যার একটি অসুস্থ হলে মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারে না। বর্তমানে শারীরিক চিকিৎসার ব্যাপ্তি বাড়লেও মানসিক চিকিৎসায় বিশ্বজুড়েই রয়ে গেছে সংকট। অথচ মানসিক রোগ বসে থাকেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে ৩০ কোটির বেশি মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে। যার প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতায়। বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও মডেল সার্ভের তথ্যমতে, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। মানসিক অসুস্থতা' কথাটি শুনলে বাংলাদেশের মানুষ বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ ঘৃণায় মুখ বাঁকায়, কেউ অবজ্ঞায় নাক সিটকায়, আবার কেউবা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। মানসিক অসুস্থতা সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে তীব্র লজ্জা আর আতঙ্কের একটি ব্যাপার। কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হলো মানে সে যেন বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেললো যার কলঙ্ক তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি এদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি রীতিমতো অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং আঁতকে ওঠার মতো। এখানে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের 'পাগল' মনে করা হয়।

কিন্তু কেন? কী দোষ তাদের? তাদের দোষ একটাই। তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। অথচ অসুস্থতার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় যেকোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানসিক রোগ জ্বর, সর্দি, যক্ষ্মা, টাইফয়েড বা ক্যান্সারের মতোই একটি রোগ। সমস্যা হলো, এদেশের মানুষ মানসিক রোগকে কোনো রোগ বলেই মনে করে না। তাই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের রোগীও মনে করে না যে তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে। আর গত সাড়ে তিন বছরে করোনায় দেশে আত্মহত্যাসহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে কেউ না কেউ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ হারায়। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ আত্মহত্যা। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যায় মারা যায়। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এ হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মত ডব্লিউএইচওর। দেশে প্রতি বছর ঠিক কত মানুষ আত্মহত্যা করে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। গেল এক বছরে পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ নারী-পুরুষ।স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন, যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের দশমিক ৫০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রতি লাখ মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ২ জনেরও কম। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এই সংখ্যা ৬০ জনেরও বেশি। তবে আশার কথা হলো, বিশ্বজুড়ে গড়ে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। পৃথিবীর স্বাস্থ্যখাতের মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ ভাগ ব্যয় হয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবায়। এ কারণেই এই খাতের সন্তোষজনক অগ্রগতি তেমন দেখা যায় না।

বিশ্বে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের বাস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। একইভাবে যাদের মানসিক রোগ আছে, তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোক এসব দেশের বাসিন্দা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণ্নতা ব্যাপক আকার নেবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের বেশি) মানুষের মধ্যে ১৮ শতাংশের বেশি কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ১২ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর (৭-১৭ বয়সী) মধ্যে মানসিক রোগ শনাক্ত করা গেছে।

দেশে নারীদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছেন না ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগ নিয়ে বেশি সংস্কার ও নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। এমনকি সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আসার হার ২ শতাংশেরও কম। এছাড়া প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় ৮০ লাখ মৃত্যু (১৪.৩ শতাংশ) মানসিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্বজুড়ে ৯৭ কোটি মানুষ মানসিক অসুস্থতা বা মাদক ব্যবহারজনিত সমস্যায় ভুগছেন। আবার এ খাতে দক্ষ জনবলেরও স্বল্পতা আছে। তবে গত কয়েক বছরে এ খাতের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আগের চেয়ে আগ্রাধিকার পাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্যমতে, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টিকে সঠিক গন্তব্যের দিকে নিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। হতাশার দিক চিহ্নিত করে তারা বলেন, দেশের কত মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, তার সঠিক তথ্য নেই। জনশুমারিতে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের নজরদারি অতীতের চেয়ে বেড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

কারণ সমূহ

১. জেনেটিক (পিতা-মাতা বা পূর্ব পূরুষদের মস্তিষ্ক বিকৃতি থাকলে অনেক সময় সন্তানদেরও মানসিক রোগ প্রকাশ পায়) ২. শরীরে কোনো কঠিন ব্যাধি ৩. অতিরিক্ত নেশা ৪. মস্তিষ্কে আঘাত লাগালে ৫. হঠাৎ ভয় পেলে ৬. মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অত্যধিক আনন্দ, দুঃখ, নিরাশ। ৭.পরিবেশগতভাবে ৮. নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি।

লক্ষণ সমূহ

একজন লোক মানসিকভাবে সুস্থ কিংবা অসুস্থ খুব সহজে বুঝা যায় না। অনেক মৃদু রকমের মানসিক রোগ আছে, যেগুলো খুব সহজে ধরা পড়ে না, যেমন-অ্যাংজাইটি, হালকা বিষণ্ণতা। আমরা যদি লক্ষ করি যে, দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপ, আচার-আচরণ এগুলো ক্রমশ পরিবর্তন হচ্ছে। এত সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং অন্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। এটি নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি দিন থাকছে। তখন মানিক রোগ হয়েছে বলে আমরা মনে করি। যেমন-একটি লোক হয়তো বেশি কথা বলছে, রাগ বেশি করছে, বেশি টাকা খরচ করছে, অন্যের সঙ্গে বেশি খারাপ কাজ করছে। এটা দুই-তিনদিন হয়তো অন্যরা মেনে নিবে, কিন্তু এটি যদি ক্রমাগতভাবে দুই মাস ধরে অব্যাহত থাকে, তখন এটিকে আমরা মানসিক রোগ বলি।’

মানসিক রোগীকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- মৃদু ও মাঝারি বা তীব্র আকারের মানসিক রোগ। মৃদু রোগী হলো-অ্যাংজাইটি, মন খারাপ, নিদ্রার সমস্যা ও কিছুটা বিষণ্ণতা। এতে রোগীর খুব বেশি অসুবিধা হয় না। তীব্র আকার রোগী যারা, তাদের জ্ঞান লোপ পায়, আচরণ অত্যান্ত রুঢ় হয়ে যায়, অনেক সময় ভাঙচুর করে। এ সময় অনেক অভিভাবক রোগীকে চিকিৎসার জন্য না এনে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। এটি ঠিক নয়।’মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে:

* হঠাৎ হঠাৎ করে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠা।

* অনেকদিন ধরে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে গুটিয়ে রাখা।

* টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মন খারাপ থাকা।

* অন্যদের সঙ্গে একেবারে কথা বলতে না চাওয়া।

* সবার সাথে ঝগড়া করা।

* গায়েবি আওয়াজ বা কথা শুনতে পাওয়া।

* অন্যদের অকারণে সন্দেহ করতে শুরু করা।

* গোসল বা দাঁত মাজার মতো নিয়মিত প্রাত্যহিক কাজ করা বন্ধ করে নিজের প্রতি যত্ন না নেয়া।

* যেসব কাজে আনন্দ পাওয়া সেসব কাজে নিরানন্দ ও আগ্রহ কমে যাওয়া।

* সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া।

* নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া সবকিছুতে।

* সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা পরিকল্পনা ও চেষ্টা করে।

* অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্থ হয়ে ওঠা।

* ঘুম অস্বাভাবিক কম বা বাড়তে পারে।

* খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া।

* বাসার, অফিসের বা পেশাগত কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়া বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, এই সমস্যাগুলোর মানেই যে তার মানসিক রোগ হবে, তা নয়। তবে এসব উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা গেলে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা উচিত। তারা সেটা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন যে, এখানে আসলে কোন ব্যবস্থা নেয়া উচিত কিনা।

মানসিক রোগের প্রকারভেদ

মানসিক রোগ কত প্রকার মোটা দাগে ভাগ করলে মানসিক রোগ দুই প্রকার: (১) নিউরোসিস (২) সাইকোসিস

* নিউরোসিস এ রোগটি মৃদু ধরনের মানসিক রোগ, অনেক মানুষের মধ্যে বেশি মাত্রায় থাকতে পারে। রোগীর ব্যবহার ও আচরণ পরিবার বা সমাজের জন্য হুমকির কারণ হয় না। সামান্য ওষুধ চিকিসা ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে প্রতিকার করা যায়। তবে এ রোগ বারবার হওয়ার প্রবণতা বেশি।

* সাইকোসিস এ রোগটি জটিল ধরনের মানসিক রোগ, কম সংখ্যক লোক এ রোগে ভুগে থাকেন। চিকিৎসা মোটামুটিভাবে ফলদায়ক। সাইকোসিস রোগটি বারবার ফিরে আসার প্রবণতা নিউরোসিস রোগের চেয়ে কম। দুশ্চিন্তা, টেনশন, ফোবিয়া, অবসেশন, হিস্টিরিয়া ইত্যাদি নিউরোসিস রোগের উদাহরণ, অপরদিকে বিষণ্নতা ও সিজোফ্রেনিয়া সাইকোসিস রোগের উদাহরণ।

দুশ্চিন্তা রোগের অনুভূতি

* সবসময় মাথায় চিন্তা ঘোরে বিশেষত অসুখ বা অসুখের চিকিৎসা সংক্রান্ত চিন্তা সবচেয়ে খারাপ যা পরিনতি হতে পারে, মনে হয় যে সেটাই ঘটবে। যেমন ধরুন মনে হতে পারে যে অসুখটার খুব বাড়াবাড়ি হবে, বা মারা যেতে পারি।* বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাওয়া (বুক ধড়ফড় করা)* মাংসপেশিতে ব্যথা বা টানটান ভাব ও রিল্যাক্স করতে না পারা।*ঘামা * দ্রুত নিশ্বাস নেওয়া (ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া)।* মাথা ঘোরা, মনে হওয়া যে এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাব।* গ্যাস অম্বল হওয়া বা বারবার পায়খানায় যাওয়া

বিষণ্নতার অনুভূতি

* সবসময় বিষণ্ন বোধ করা এবং মনে করা যে এই বিষণ্নতা কোনোদিন কাটবে না
জীবনে কোনো কিছুতেই উৎসাহ না থাকা।

* কোনো কিছু উপভোগ করতে না পারা ছোটোখাটো ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে না পারা।* অসম্ভব বেশি ক্লান্ত লাগা সবসময় অস্বস্তি বা অস্থিরতা বোধ করা ক্ষুধা না হওয়া এবং ওজন কমা (কিছু ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হয়, ক্ষিদে আর ওজন দুটোই বাড়ে)।* ঘুম না আসা আর সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া।* সহবাসে অনীহা।* আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নিজেকে অপদার্থ, অক্ষম ভাবা অন্যের সঙ্গ বর্জন করা।* খিটখিটে হয়ে যাওয়া।* নিজের সম্বন্ধে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এবং পৃথিবী সম্পর্কেই সামগ্রিক হতাশা। মনে হতে পারে যে আমি কোনোদিন ভাল হব না, বা মনে হতে পারে আমি একেবারেই খরচের খাতায়।* আত্মহত্যার কথা মনে হতে পারে। বিষণ্নতায় এটা প্রায়ই হয়। এরকম মনে হলে তাই নিয়ে কথা বলা ভাল, সবটা মনের মধ্যে চেপে না রেখে।

মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উপায়

এখন আমরা জানবো কিভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে হয়। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার প্রথম উপায় হলো নিজের যত্ন নিতে হবে। মানসিক সুস্থতা পেতে নিজের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।

* অবদমিত আবেগ প্রকাশের ফলে মানসিক চাপ ও জটিলতা কমে যায়।

* নিজের জন্য কিছুটা সময় আলাদা রাখতে হয় নিজের মনের কথা শুনতে হয়।

* বই পড়া এবং গান শোনাও দরকার।

দুশ্চিন্তা দূর করার উপায়

অতীত ও ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমান দেখার চেষ্টা করতে হয়।তাছাড়া গতানুগতিক ডিসিপ্লিন জীবনে না থেকে একটু নিজের মত সময় কাটানোর দরকার। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার কেবল আমাদের শরীরকে নয় এমন কি মন কে ও ভালো রাখে। অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর খাবার আমাদের বিষন্নতার জন্য মারাত্মক ভাবে দায়ী। ভিটামিন বি টুয়েলভ, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার আমাদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন গুলোকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া তাজা ফলমূল ও শাকসবজি একটা বড় ভূমিকা রাখে। আমাদের মানসিক শাস্তি পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের ঠিক থাকে।

এক মাসে ৫ কেজি ওজন কমানোর ডায়েট প্লান

শরীর সুস্থ রাখতে যেমন পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। তেমনি মনকে সুস্থ রাখতেও ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। ফলে আমরা ক্লান্তি বোধ করি। কমে যায় আমাদের কর্মস্পৃহা। ঘুম আমাদের শরীরে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ গুলো সারিয়ে তোলে। আমাদের মনকে চাঙ্গা করে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে আমাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম খুব বেশি জরুরি। এরপরে নিয়মিত ব্যায়াম। মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে শারীরিক ব্যায়াম খুবই জরুরী। স্ট্রেস ও বিষণ্নতা কাটাতে ভীষণ কাজে লাগে। ব্যায়ামের ফলে শরীরের ক্লান্তি ও মানসিক চাপ হ্রাস পায়। তাই মনকে চাঙ্গা রাখতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।

দ্রুত ওজন কমানোর উপায়

শখের কাজ করা। নিয়মিত অভ্যাসের একটু বাইরে গিয়ে যেসব বিষয়ে করলে মন ভাল থাকে ওই ধরনের কাজ করা। যেমন অনেকের ছবি আঁকতে ভালো লাগে, বাগান করতে ভালো লাগে,রান্না করতে ভালো লাগে, যখন মন খারাপ থাকবে তখন এই ধরনের কাজগুলো করা উচিত এতে মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়।

নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা উচিত

মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানো। প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটালে মানসিক হতাশা অনেকাংশে কেটে যায়। পরিবারের সাথে মন খুলে মেলামেশা করলে, মন খুলে কথা বললে, আলিঙ্গন করলে, মানসিক হতাশা অনেকাংশে কমে মানসিক সুস্থতা লাভ করা যায়। এছাড়াও অন্য একটি উপায় রয়েছে যার মধ্য দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়, সেটি হল নিজের মনের যত গোপন কথা অর্থাৎ যে সকল বিষয় নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন, কাছের কোন মানুষের সাথে কথা গুলো শেয়ার করা। এতে করে নিজের মন অনেক হালকা হয়ে যায়। এবং মানসিক সুস্থতা ফিরে পাওয়া যায়।মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এ হার কমিয়ে আনা সম্ভবমানসিক রোগ নিয়ে অজ্ঞতা, অসচেতনতা আর কুসংস্কারের ফলে মানসিক রোগ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই স্বীকার করতে চান না অনেকে।

গায়েবি আওয়াজ শোনা, ভ্রান্ত কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস, অহেতুক সন্দেহ, আচার-আচরণ বা কথাবার্তার অস্বাভাবিক পরিবর্তন, কনভার্সন ডিসঅর্ডার (যা হিস্টিরিয়া বা মূর্ছারোগ নামেই বেশি পরিচিত)-এর উপসর্গগুলোকে জিন-ভূতের আছর,জাদু-টোনা-তাবিজ-আলগা বাতাসের প্রভাব বলেই বিশ্বাস করেন অনেকে। আত্মীয়স্বজন এসব সমস্যায় আক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসাও করান তেল-পড়া, পানি-পড়া, তাবিজ, ঝাড়-ফুঁক, ‘শিকল থেরাপি’ ইত্যাদির মাধ্যমে। অনেকের কাছে মানসিক রোগের উপসর্গগুলো বয়সের দোষ, বিয়ের জন্য টালবাহানা, ঢং বা ভং ধরা। চিকিৎসার ব্যাপারে এদের বিশ্বাস- ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই।’ কখনো কখনো শারীরিক উপসর্গ যে মানসিক রোগের কারণে হতে পারে- তাও অনেকে মানতে চান না। ফলে, মানসিক সমস্যার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শারীরিক উপসর্গ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন তারা। এতসব কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে যারা মানসিক রোগ চিকিৎসার আওতায় আসেন, তাদেরও বড় একটা অংশ ওষুধ নিয়ে নানান বিভ্রান্তিতে সঠিক চিকিৎসা করান না। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে মানসিক রোগ চিকিৎসার আধুনিক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। এর পর সময়ের গতির সঙ্গে মানসিক রোগ চিকিৎসারও অগ্রগতি সাধিত হয়, আবিষ্কৃত হয় নতুন নতুন ওষুধ, সেসব ওষুধের সফল প্রয়োগ মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে মানসিক রোগের ওষুধ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বিদ্যমান।

যেসব কারণে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা জরুরি

* মানসিক রোগ ও তার লক্ষণ সম্পর্কে জানা চিকিৎসাসংক্রান্ত সঠিক তথ্য জানা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা

* মানসিক রোগের কারণ ও চিকিৎসাবিষয়ক কুসংস্কার দূর করা মানসিক রোগ নিয়ে সমষ্টিগত নীরবতার চক্র ভাঙা

* মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ও গুরুত্বসহকারে রোগীর চিকিৎসা করা মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে মানসিক রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা

হোমিও সমাধান

মানসিকভাবে সুস্থতার মানে কি আবেগ-অনুভূতির শূণ্যতা ? হ্যানিম্যান প্রমাণ করে গেছেন যে, শারীরিক কোন রোগের কুচিকিৎসাই হলো অধিকাংশ মানসিক রোগের মূল কারণ, মানসিক রোগীর জন্য প্রাথমিক ভাবে যেইসব মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে.নাক্স ভুমিকা, থুজা, সালফার
অরাম মেট, প্লাটিনা, পালসেটিলা, স্ট্র্যামোনিয়াম, ভিরেট্রাম, ইগ্নেসিয়া, নেট্রাম মিউর, এসিড ফস, ল্যাকেসিস, চায়না, বিউফো রানা, ককুলাস ইন্ডিকা,ব্যারাইটা মিউর সহ আরো অনেক মেডিসিন আসতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, যেকোনো অসুস্থতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। মানসিক অসুস্থতাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমাদের প্রয়োজন মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে এসে এই সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ করা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটানো। আমাদের উচিত মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সবধরনের সমর্থন দেওয়া। তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করে সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

ভাবুন তো, জীবন খুবই অনিশ্চিত। হতে পারে একদিন আপনিও মানসিক রোগে আক্রান্ত হবেন। তখন যেন আপনার পরিবেশ-প্রতিবেশ আপনার অনুকূলে থাকে এজন্য হলেও আপনার এই কাজগুলো করা উচিত।

লেখক : চিকিৎসক কলাম লেখক ও গবেষক. প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।