মাদকাসক্ত হলে থাকা যায় না যে গ্রামে
একে আজাদ, রাজবাড়ী : মোহাম্মদ ইবাদত শেখ। খেলার সাথীদের পাল্লায় পড়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে জড়িয়ে যান মাদকের সঙ্গে। জীবনের ৩০টি বছর কাটিয়েছেন এই অন্ধকার জীবনে। তবে সম্প্রতি তিনি ফিরেছেন এই অন্ধকার জীবন থেকে। এখন এক ভিন্নরকম জীবন উপভোগ করছেন ইবাদত। নিজেও লড়ছেন মাদকের বিরুদ্ধে। ইবাদত শেখের এই আলোর পথে ফেরা খুব সহজ ছিল না। গ্রামের তরুণদের উদ্যোগে পুরো গ্রামবাসীর চাপে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। আর এই চাপ প্রয়োগে নেতৃত্ব দিয়েছেন খোদ তার সন্তানও।
ইবাদত শেখ বলেন, ‘গ্রামের মধ্যে আমরা ৫-৬ জন ছিলাম চরমভাবে মাদকাসক্ত। গ্রামের মানুষ চতুর্দিক থেকে আমাদের বাধা দিলেও আমরা কয়েকজন যেভাবেই হোক মাদক নিতাম। কারণ, মাদক ছাড়া এক রাত থাকলে মনে হতো মারা যাবো। কিন্তু, গ্রামের মাদক নির্মূল কমিটি এত কঠোর ছিল যে, তাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারিনি। আমার ছেলে, ভাই, ভাতিজারাও এই দলে ছিল। সবাই মিলে আমাকে ধরে বিচার করে পুলিশেও দিয়েছিল। পরে তারাই আবার ছাড়িয়ে এনে ধিরে ধিরে মাদক থেকে ফিরিয়েছে। প্রথমে ছাড়তে অনেক কষ্ট হয়েছে। নেশা উঠলে নিজেকে নিজে পেটাতাম। তখন কষ্ট হলেও এখন যে জীবন পার করছি, এটাকে জান্নাতী জীবন মনে হচ্ছে।
শহরের পাইকারি বিক্রেতাদের থেকে কিনে এনে ইবাদত শেখের মতো গ্রামের মাদকাসক্তদের হাতে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য পৌঁছে দিতেন গ্রামের আরেক যুবক। তিনিও বাধ্য হয়েছেন মাদকের পথ ছাড়তে। এখন করছেন রাজমিস্ত্রীর কাজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আগে মাদক বিক্রি করে ভালো আয় করতাম ঠিকই, কিন্তু মনে শান্তি ছিল না। সংসারেও শান্তি ছিল না। সারাদিন পুলিশের আতঙ্ক আর অস্থিরতা থাকতো। আরও কত সমস্যা। এখন রাজমিস্ত্রির কাজ করি। আয় কম, কিন্তু সব টাকাই পরিবারকে খাওয়াই। বৌ-বাচ্চা, মা-বাবা সবাই খুশি। শান্তিতে জীবনযাপন করছি। এখন আমি নিজেও মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। একটা মানসিক শান্তি পাচ্ছি।
গল্প দুটি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দী উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের চর বহরপুর গ্রামের। সেখানকার শান্তি মিশন যুব সংঘের উদ্যোগে নানানভাবে বাধ্য করে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্তত অর্ধশত মানুষকে ফিরিয়ে এনেছেন মাদক থেকে। শুধু মাদক থেকে ফিরিয়ে আনাই নয়, দিয়েছেন কর্মসংস্থানও। উদ্যোক্তারা জানান, মাদকবিরোধী আন্দোলনে এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করে মাদকাসক্তদের সমাজ থেকে কোণঠাসা করে দেওয়াসহ নানানভাবে চাপ প্রয়োগ এবং প্রয়োজন ভেদে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে করেছেন এই অসাধ্য সাধন। এই কাজ করতে গিয়ে শুরুতে ছিল অনেক প্রতিবন্ধকতাও। তবে সব উৎরে সফল হয়েছেন তারা। এভাবে আশপাশের অন্তত ৭টি গ্রামকে মাদকমুক্ত করেছেন তারা।
শান্তি মিশন যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক পিয়াস খান বলেন,‘আমরা দল বেধে সন্ধ্যার পর পুরো এলাকায় টহল দেই। সম্ভাব্য যেসব জায়গায় মাদক সেবন হতে পারে সেগুলোতে হানা দিয়ে মাদকাসক্তদের ধরে আনতাম। পরে তাদের এলাকার মুরুব্বিদের সামনে আনতাম। মুরিব্বিরা প্রথমে সতর্ক করে পরিবারের সদস্যদের হাতে দিয়ে দিতো। তাতেও কাজ না হলে আমরা পুলিশে দিয়ে দিতাম। জেল থেকে আসার পর থেকে তাকে সবসময় নজরদারিতে রাখতাম যেন মাদক কেনার বা সেবন করার সুযোগ না পায়। এভাবে কিছুদিন দূরে রাখা গেলে তারা সংশোধন হয়ে যায়। তারপর এলাকার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় আমরা তাকে কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে দেই। যেন সে আর এই পথে না ফেরে।’
এই কাজে কোনো বাধা ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম দিকে মাদক ব্যবসায়ীরা আমাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের থানায় মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। তবে, পুলিশ তদন্ত করে সত্যতা পায়নি। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীরা আমাদের ওপর বিভিন্ন সময় হামলাও করেছিল। কিন্তু, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকায় তারা সফল হতে পারেনি। এখন আর তেমন বাধা নেই। এখন আশপাশের গ্রামগুলো আমাদের এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। আমাদের ইউনিয়নেরই ৭টি গ্রামে এই পদ্ধতি অবলম্বন শুরু হয়েছে।
চর বহরপুরকে মাদকমুক্ত করার প্রধান উদ্যোক্তা বাংলাদেশ মাদক নির্মূল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ হাকিম বলেন, আমরা স্থানীয় তরুণ-বৃদ্ধ সব পর্যায়ের মানুষ, মাদকসেবীদের পরিবার এবং প্রশাসনকে এক ছাতার নিচে এনে সকলের সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রামকে মাদকমুক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু সারাদেশের সাড়ে ৮৭ হাজার গ্রামের মধ্যে এক-দুইটাকে মাদকমুক্ত করার মধ্যে কিছু আসে যায় না। তবে আমরা মনে করি, এই আদর্শ অনুসরণ করে দেশের সব গ্রামকেই মাদকমুক্ত করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা আর সমন্বিত উদ্যোগ। মাদক নির্মূলে সরকারের সহযোগিতায় সারাদেশের গ্রাম পর্যায়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন তিনি।
(একে/এসপি/সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪)