কন্যা সন্তানের প্রতি বৈষম্য নয়, প্রয়োজন সর্বোত্তম সুন্দর আচরণ করা
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আগামীকাল সোমবার জাতীয় কন্যাশিশু দিবস ২০২৪। প্রতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় কন্যা-শিশু দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশের সমাজে যাতে নারীরা ভেদাভেদ বা বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কন্যা-শিশু দিবস পালনের আদেশ জারি করে।
আদেশে বলা হয়, শিশু অধিকার সপ্তাহ (২৯ সেপ্টেম্বর হতে ৫ অক্টোবর) মধ্যে একটি দিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যা-শিশু দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘২০২৪ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কন্যাশিশুর স্বপ্নে গড়ি আগামীর বাংলাদেশ’।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র সমূহে ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছরের ১১ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস। এদিকে প্রতিবছরের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিশু সপ্তাহ পালন করা হয়। এই শিশু সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর পালন করা হয় জাতীয় কন্যা-শিশু দিবস হিসেবে। আজকের কন্যা-শিশুর মধ্যেই সুপ্তভাবে বিরাজ করছে আগামী দিনের আদর্শ মা। কন্যা-শিশুদের জন্য বিনিয়োগ হবে যথার্থ বিনিয়োগ। কারণ আজকের কন্যা-শিশুই আগামী দিনে গড়ে তুলতে পারবে একটি শিক্ষিত পরিবার ও বিশ্ব-সভায় নেতৃত্ব দানে পারদর্শী সুযোগ্য সন্তান। আর সারা বিশ্বেই নানা কারণে কন্যা-শিশুরা বেশ অবহেলিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মর্যাদা, ভালোবাসা—সব দিক থেকেই বলতে গেলে তারা বঞ্চিত। শুধু যে আমাদের দেশের চিত্র এমন তা কিন্তু নয়। সারা বিশ্বেই কোনো না কোনো জায়গায় প্রতি মুহূর্তে অবহেলার শিকার হচ্ছে কন্যা-শিশু। পরিবার ছাড়াও সামাজিকভাবেও তারা হচ্ছে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত। সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রসহ সমস্ত স্থানে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ দূরীকরণ হলও কন্যা-শিশু দিবস অন্যতম উদ্দেশ্য। গৃহ-পরিবেশে একজন পুত্রসন্তানকে যেভাবে গুরুত্ব সহকারে আদর-যত্নে লালনপালন, শিক্ষার প্রতি যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেভাবেই একজন কন্যা-শিশুর মানসিক নিপীড়নের হাত থেকে মুক্ত করার কথাই উচ্চারিত হয়ে থাকে এ দিবসে।
বিশ্বজুড়ে নারী ও কন্যা-শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নৃশংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স আঠারো বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যা-শিশু যাদের পিছনে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কন্যা-জায়া-জননীর বাইরেও কন্যা-শিশুর বৃহৎ জগত রয়েছে। স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করা ছাড়াও পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। এজন্য কন্যা-শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ বেড়ে ওঠার সব অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
কন্যা-শিশু সুরক্ষা পেলে সব বৈষম্য দূর হবে। কন্যা-শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে নেওয়া হয়েছে কঠোর আইন। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে কন্যা-শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কন্যা-শিশুর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে পুরুষকে। আর আমাদের দেশে আগে কোনো পরিবারে কন্যা সন্তান হলে খুশি না হওয়ার একটা ব্যাপার ছিল সেটা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। আগের মতো এখন আর সেই আক্রোশগুলো নেই যেটা আগে কন্যা সন্তান হলে দেখা যেতো। তবে এখন দেখা যাচ্ছে একটা কন্যা সন্তান হলে বাবা মা যতটা খুশি হয়, তো পরবর্তীতে তারা বড় হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক প্রেক্ষাপটে তারা অনেক বেশি কোণঠাসা হয়। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়, নির্যাতনের শিকার হয় ও অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তো সেইদিক থেকে এখনো কন্যা-শিশুরা পিছিয়ে আছে। আমাদের সমাজে এখনও কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা হয়। আর আমাদের দেশের শিশুকন্যা সন্তানরা একেবারেই নিরাপদে নেই। সরকার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও শিশুকন্যারা নিরাপদে নেই। কেন নেই সেটা যদি বলি তাহলে বলবো আমরা সমাজের মানুষরা সচেতন না।
আমাদের অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিশুকন্যার অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আমরা জানি যে একটা কন্যা সন্তান আমাদের পরিবারের জন্য অনেক উপকারী, বাবা মায়ের জন্য ভালো চিন্তা করে। কিন্তু আসলে পরিবারের মানুষগুলো কন্যাসন্তানের মন-মানসিকতা, চিন্তাভাবনা বোঝার চেষ্টা করেনা তাদের কোথায়, কেন, কি সমস্যা হচ্ছে সেদিকে গুরুত্ব দেয়না। আমরা সবাই কিন্তু জানি কন্যারা তার পরিবারের অনেক উপকারে আসে, বিপদে পরিবারের পাশে থেকে সমস্যা সমাধান করার মতো যোগ্যতা আছে। তারপরেও আমাদের দেশের কন্যাদের সঠিক অধিকার ও সুরক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়না।
আমাদের দেশের কন্যারা বর্তমান সমাজে নিরাপদ নয়। রাস্তা ঘাডে চলতে গেলে নানা ধরনের বিপদে পড়ে হয়। এমনকী শিশুকন্যারা এখন নিজের কাছের মানুষদের কাছেও নিরাপদ নয়। তাই পরিবারের অভিভাবকদের উচিৎ শিশুকন্যাদের সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। আমাদের দেশে ছেলেদের থেকে কন্যাসন্তানরা সব কিছুতে অবহেলিত। কোনো কোনো পরিবারে মানুষ মনে করে ছেলেরা আমাদের দেখবে মেয়েরা তো আর আমাদের দেখবেনা। তাকে বিয়ে দিয়ে অন্যের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে তাদের এতো পড়াশোনা করিয়ে কী হবে। আবার বাইরে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও বাধা দেওয়া হয়। তো সবদিক থেকেই দেখা যায় আমাদের দেশের কন্যা-শিশুরা অবহেলিত ও নির্যাতিত।
কন্যা শিশুদের করণীয়
* নিজে অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে;
* অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং সুযোগগুলোকে সদ্ব্যবহার করতে হবে;
* নিজের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট/ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে এবং নিজের মতামতকে প্রকাশ করতে হবে।
মা-বাবা/অভিভাবকদের করণীয়:
* মেয়ের/ কন্যা শিশুর প্রয়োজনগুলো শুনতে হবে, বুঝতে হবে এবং তাদের যেকোন প্রয়োজনে সাড়া দিতে হবে বা সাহায্য করতে হবে;
* মেয়ের/কন্যা শিশুর জীবনের সাথে জড়িত যেকোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার মতামত শুনতে হবে, তার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে হবে;
* মেয়ে/ কন্যা শিশুকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় সব সময় স্বাগত জানাতে হবে;
* মেয়ে/কন্যা শিশুকে সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার পরিপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে, কেননা, সমস্ত মেয়ে এবং ছেলেদের একই অধিকার রয়েছে এবং প্রত্যেকের একটি মর্যাদাপূর্ন জীবনযাপনের সুযোগ থাকা উচিত;
* শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়ে ও ছেলে শিশুর উভয়কে সমান সুযোগ দিতে হবে।
সরকারি/বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের করণীয়
* মেয়ে/ কন্যা শিশুকে সব ধরনের নির্যাতন বা সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে সচেষ্ট থাকতে হবে;
* সম্ভাব্য সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে বা সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা পেতে সহায়তা করতে হবে।
* সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত ও মাসিক বান্ধব টয়লেট এর ব্যবস্থা করতে হবে;
* সকল ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে এবং নেতৃত্ব বিকাশ ও সম্ভাবনাগুলো অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে;
* উন্নয়ন কর্মসূচিসমূহে মেয়েদেরকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই,কন্যা শিশুদের অধিকার, তাদের প্রতি সহনশীল আচরণ, শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পিতা মাতার অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাই কন্যা সন্তানের প্রতি বৈষম্য নয়, অনাদর অবহেলা নয়, তাদের সঙ্গে সর্বোত্তম সুন্দর আচরণ করা জরুরি। কন্যা বা নারীরা পণ্য নয় বরং ইসলাম কন্যা ও নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।