শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : ভেঙে গেছে দেয়াল। ছেয়ে গেছে লতাপাতা ও গাছের ডালে। চারপাশ জঙ্গলে ঢাকা। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে বাঁধা গরু। পানিতে চরছে হাঁস। ঝিনাইদহ সদরের পদ্মাকর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সরকারি আবাসিক বাসভবনের চিত্র এটি। ১৭ বছরের বেশি সময় ভবনটির এমন নাজুক অবস্থা। বেহাল অবস্থায় রয়েছে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের আওতাধীন ১৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সরকারি আবাসিক বাসভবন। স্বাস্থ্য বিভাগের আওতাধীন দুটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রেরও একই অবস্থা।

পদ্মাকর এলাকার চম্পা খাতুনের ভাষ্য,‘এই আবাসিক বাসভবনটি কেউ পরিষ্কার করে না। সাপ-পোকা থাকে এখানে।

জানা গেছে, আবাসিক ভবনে থাকা বাধ্যতামূলক পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের কেন্দ্র বাধ্যতামূলক নয়। এসব ভবনের অধিকাংশই ফাঁকা পড়ে আছে।

জেলা সদর হাসপাতালের আটটি আবাসিক ভবনের মধ্যে সিনিয়র কনসালট্যান্ট, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর বাসভবন ও চতুর্থ শ্রেণির একটি ভবন দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমেছে। চুরি হয়ে যাচ্ছে জানালা-দরজা। চতুর্থ শ্রেণির ভাঙাচোরা ভবনে বসছে মাদকের আড্ডা। সবকটি আবাসিক ভবনের চারপাশেই বন-জঙ্গলের স্তূপ। এ তথ্য জানিয়ে হাসপাতাল-সংলগ্ন এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, সরকারি এসব ভবন পরিচ্ছন্ন ও সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করা দরকার। দায়িত্বরতরা যেন এখানে থেকে সেবা দিতে পারেন।

১৭ থেকে ২৮ বছর বয়সী এসব বাসভবন। সম্প্রতি সদরের সাধুহাটি, হলিধানী, কুমড়াবাড়িয়া, সাগান্না, পদ্মাকর, পোড়াহাটি, পাগলাকানাই, হরিশংকরপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘুরে বিভিন্ন অসংগতি পাওয়া গেছে।

পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, সদরের ১৭টি ইউনিয়নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের প্রতিটি কেন্দ্রের দায়িত্বরত পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ও উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের জন্য আবাসিক ভবনে থাকা বাধ্যতামূলক।

ভাড়া বাবদ তাদের বেতন থেকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে কাটা হয়। শুধু সাগান্না, মহারাজপুর, মধুহাটি ইউনিয়নে দায়িত্বরতরা বসবাস করেন। হলিধানী, সুরাট, নলডাঙ্গা ও ফুরসুন্দি কেন্দ্র সংস্কার করা হয়েছে। সদরের সাধুহাটি ও হরিশংকরপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে। এ দুই কেন্দ্রের দায়িত্বরতদের আবাসিক ভবনে থাকা বাধ্যতামূলক নয়।

সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালের আটটি আবাসিক ভবনে ২৬টি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা আছে। তবে থাকে ১১টি পরিবার। বাধ্যতামূলক হলেও নিজের আবাসিক ভবনে থাকেন না আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা। সদরের সাধুহাটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আবাসিক ভবনে ২৮ বছরেও থাকেননি দায়িত্বরতদের কেউ। সেখানে তৎকালীন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ও গ্রামের লোকজন একটি মসজিদের ইমামকে থাকতে দেন। আট বছর আগে গ্রামের লোকজন আরও একজনকে থাকতে দিয়েছেন। এটি উদ্ধার কিংবা দায়িত্বরতদের বসবাসে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ।

পুরোনো ভবনে থাকার পরিবেশ নেই বলে দাবি স্বাস্থ্য বিভাগের আওতাধীন সাধুহাটি কেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রফিকুল ইসলামের। নিয়ম না থাকলেও বহিরাগতরা কীভাবে সরকারি বাসায় থাকেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগের দায়িত্বরতরা থাকতে দিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

কুমড়াবাড়িয়া কেন্দ্রের আবাসিক ভবনে ১৬ থেকে ১৭ বছর কেউ থাকেন না। পোড়াহাটি কেন্দ্রের আবাসিক ভবনে কেউ থেকেছেন কিনা, তা জানাতে পারেননি দায়িত্বরত পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা। হলিধানী কেন্দ্রটি সংস্কার করা হলেও সেখানে কবে, কে থেকেছেন, তাও বলতে পারেননি দায়িত্বরত কেউ। কুমড়াবাড়িয়া কেন্দ্রের আবাসিক ভবনের চারপাশ ছেয়ে গেছে জঙ্গলে। জানালা ভেঙে পড়ছে। ভেতরে পোকামাকড়ের বিষ্টা।

পোড়াহাটি কেন্দ্রের টিনশেডের আবাসিক ভবনের চারপাশ জঙ্গলে ছেয়ে আছে, নেই দরজা-জানালা। হলিধানী আবাসিক ভবনে রং আর জানালার কাজ করা হলেও ভেতরে মানুষের পরিবর্তে বাদুড়ের আবাস। অধিকাংশ বাসভবন চত্বরে আবর্জনার স্তূপ। এসব কালেভদ্রেও পরিষ্কার করেন না কেউ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এসব ভবন বিষধর সাপের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। দু-একটি কেন্দ্রে কর্মকর্তা আসার কথা শুনলে সামনের অংশ পরিষ্কার করেন দায়িত্বরতরা।

সদরের পদ্মাকর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা রিক্তা খাতুন চার বছর ধরে দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আসার আগে থেকেই এটি নষ্ট পড়ে আছে, থাকা যায় না। আমিও থাকি না।’

কুমড়াবাড়িয়া কেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেনের ভাষ্য, ভাঙাচোরা ভবন ব্যবহার হয় না। থাকার পরিবেশও নেই। ১৫ থেকে ১৬ বছর কেউ থাকে না। যে কারণে তিনিও থাকেন না।

কিছু অসংগতির কথা স্বীকার করে বাসভবনগুলো ব্যবহারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক মোহা. মোজাম্মেল করিম। তিনি বলেন, কিছু ভবন সংস্কার হয়েছে। এখানে যেন দায়িত্বরতরা থাকেন, সে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গত সোমবার ছুটিতে গেছেন সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম। এর আগে তিনি বলেন, শুধু আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ব্যতীত আবাসিক ভবনে কারও থাকা বাধ্যতামূলক নয়। এ বাসভবনে থাকলে কর্মরতদের পদক্রম অনুসারে বেতনের বেসিকের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ টাকা ভাড়া বাবদ কাটা হয়। ফলে অনেকেই থাকেন না। তাদের বাধ্য করারও কোনো সুযোগ নেই।

(এসআই/এসপি/সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪)