এখনও শতভাগ সাক্ষরতার মাইফলক ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আগামীকাল রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে “আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২৪”। বিশ্বের সকল দেশের জন্য ইউনেস্কো নির্ধারিত এবারের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বহু ভাষায় শিক্ষার প্রসার: পারস্পরিক সমঝোতা ও শান্তির জন্য সাক্ষরতা’। ১৯৬৭ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এবং ১৯৭২ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদ্যাপন হচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হলো সাক্ষরতা অর্জন করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সাক্ষরতার সংজ্ঞায় ভিন্নতা থাকলেও ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো সর্বজনীন একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। তখন শুধু কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। পরবর্তীতে প্রায় প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে এবং ১৯৯৩ সালের একটি সংজ্ঞায় ব্যক্তিকে সাক্ষর হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে। সাক্ষরতা এবং উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। নিরক্ষরতা উন্নয়নের অন্তরায়। টেকসই সমাজ গঠনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন তা সাক্ষরতার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও শতভাগ সাক্ষরতার মাইফলক ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ। খোদ সরকারি হিসাবই বলছে, এখনও দেশের ২৩ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। যাদের বয়স ৭ বছরের বেশি। প্রায় ৩ কোটিরও বেশি এই জনসংখ্যাকে সাক্ষর জ্ঞান দিতে আপাতত কোনো উদ্যোগও নেই অন্তবর্তী সরকারের। শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও এসে শতভাগ স্বাক্ষরতার স্বপ্ন অধরা থেকে যাওয়া গত রাষ্ট্রের জন্য বিরাট ব্যর্থতা রয়েগেছে। এটা প্রশাসন, আমলাতন্ত্র ও বিভিন্ন সময়ে থাকা সরকারেরও ব্যর্থতা। কারণ আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার, তা দেওয়া হয়নি। হয়তো এখন দেওয়া হচ্ছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিবেদনে বলা হয়, জনশুমারি ও গৃহগণনার ২০২২-এর ভিত্তিতে ১ জানুয়ারি ২০২৪ সালে প্রাক্কলিত জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার। যেখানে নারী ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৯০ হাজার এবং পুরুষ ৮ কোটি ৪২ লাখ জন।
কত জন নিরক্ষর?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়ার তথ্য উল্লেখ করে সেই সময় জাকির হোসেন জানিয়েছিলেন যে সেখানে এখন সাক্ষরতার হার ৭৬.৮ শতাংশ। গত বছর, ডিসেম্বর মাসে, সাক্ষরতা দিবস উদ্যাপনের তথ্য জানাতে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ নিরক্ষর। এরা সকলেই সাত বছরের বেশি বয়সী।বাংলাদেশে ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রায়োগিক সাক্ষরতা প্রায় ৭৩ শতাংশ। আর ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের এই হার ৭৩.৬৯ শতাংশ।
সাক্ষরতা বৃদ্ধি
যদিও বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। ২০১১ সালেও সেখানে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১.৭৭ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৭৪.৬৬ শতাংশ। কিন্তু এক বছরে সেখানে সাক্ষরতার হার বাড়ে ১.৪২ শতাংশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের দাবি, সাক্ষরতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলক ভালো।
আটটি দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ তিন নম্বরে এবং এই ক্ষেত্রে তারা ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে। বিবিএসের হিসাবে, সেখানে ৭৬.৭১শতাংশ পুরুষ এবং ৭২.৯৪ শতাংশ মহিলা সাক্ষর। সেখানে গ্রামাঞ্চলে সাক্ষরতার হার ৭১.৬৮শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে তা ৮১.৪৫ শতাংশ।আমাদের সাক্ষরতার বৃদ্ধির হার কেন শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে না, তার মূল কারণ সাক্ষরতা একটি দক্ষতা অর্জন মাত্র যার সঙ্গে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নটি কোনোমতে অতি কষ্টে ঝুলে আছে। অথচ শিক্ষার গোড়ার কথা এই নীতিনৈতিকতা ও সমাজের মানুষের কল্যাণে কর্মকাণ্ড। এ বিষয়ে ধারণাটি স্পষ্ট না থাকলে আমরা অন্ধকারেই ঘুরপাক খাব, সাক্ষরতার হার বাড়লেও শিক্ষার ছোঁয়া পাওয়া যাবে না। অথচ আমাদের এখন প্রকৃত শিক্ষা অনেক বেশি প্রয়োজন।
বর্তমানে গবেষণাহীন শিক্ষা
আমাদের দেশের জনসংখ্যা আয়তনের তুলনায় অত্যাধিক বেশি, সম্পদ খুব সীমিত, সুযোগ-সুবিধাও কম। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবিলা করে কীভাবে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তার জন্য প্রয়োজন বাস্তবমুখী গবেষণা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য কী প্রয়োজন, কীভাবে শিক্ষা দিতে হবে, কী কারণে শিক্ষা প্রদান করতে হবে— এগুলো গবেষণার মাধ্যমে বের করে সে-অনুসারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর দরকার ছিলো।
কিন্তু আমরা তাতে অনেকাংশেই ব্যর্থ। উচ্চশিক্ষা মূলত গবেষণাধর্মী শিক্ষা। কিন্তু উচ্চশিক্ষাতে গবেষণা নেই বললেই চলে। গবেষণার জায়গায় স্থান পেয়েছে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তির লক্ষ্যে পড়াশোনা। শিক্ষকরা ব্যস্ত রাজনীতি ও বিভিন্ন লবিংয়ে। বিষয়জ্ঞান অর্জন থেকে শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছে বহুদূরে। ফলে সরকার শিক্ষার্থীদের পেছনে যে ব্যয় করছে, তা শিক্ষার অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
গুণগত শিক্ষার অনুপস্থিতি
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত একটি প্রত্যয় হলো গুণগত শিক্ষা। গুণগত শিক্ষাকে প্রধানত দুটি অংশ দেখতে পাই: প্রথমত, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ও দ্বিতীয়ত, আর্থিক নিশ্চয়তা।
গুণগত শিক্ষার প্রথম অংশ হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, নীতিনির্ধারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন। সেই শিক্ষকরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করছেন। অভিভাবকরা সেই প্রশ্ন টাকার বিনিময়ে কিনে শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। ফলে শিক্ষার্থী ছাত্রজীবনেই দুর্নীতি করা শিখছে। এটি একটিমাত্র উদাহরণ। এমন হাজারো চক্করে পড়ে শিক্ষার্থীরা হয়ে যাচ্ছে নৈতিকতাহীন ও মূল্যবোধহীন।
অপর দিকটি হলো, আর্থিক নিশ্চয়তা। বাংলাদেশে যে কর্মের নিশ্চয়তা নেই তা লাখ লাখ বেকার যুবক দেখলেই বোঝা যায়। সুতরাং, আমরা এখানেও ব্যর্থ।
অপরিকল্পিত উদ্যোগ
ব্রিটিশ আমলে ‘মেকলের চুইয়ে পড়া নীতি’, পাকিস্তান আমলে ‘শরীফ কমিশন’ অপরিকল্পিত শিক্ষা উদ্যোগের উদাহরণ। বাংলাদেশ আমলেও এমন উদ্যোগ কম নেয়া হয়নি। প্রতিটি নতুন সরকারই গঠন করেছে নতুন নতুন শিক্ষা কমিশন। কমিশনগুলো তার পূর্বের কমিশনের প্রতিবেদনগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। দেশের বাস্তব অবস্থা এবং শিক্ষার চাহিদাগুলোকে তেমন আমলে না নিয়ে নিজেদের মতো করে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ প্রদান করেছেন তারা। ছোট উদ্যোগগুলোও হয়েছে অপরিকল্পিত। সাম্প্রতিক সময়ের সৃজনশীল পদ্ধতি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ইত্যাদি উদ্যোগ বর্তমানে যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বুমেরাং হয়েছে, তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।
অপর্যাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে শিক্ষক হলেন সবচেয়ে বড় শিক্ষণ-উপকরণ। অর্থাৎ, শিক্ষকের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি শিখে থাকে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা কি আদৌ শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেকে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন? বা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি শিক্ষকদেরকে গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী?
বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে শিক্ষা
কিছুকাল আগেও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে একজন নারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে সাড়ে চার লক্ষাধিক শিক্ষক রয়েছেন, তার উল্লেখযোগ্য অংশ উচ্চমাধ্যমিক পাস। শিক্ষক হিসেবে একজন উচ্চমাধ্যমিক পাস ব্যক্তি কতোটা উপযুক্ত? অপরদিকে, যারা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর করে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেছেন, উভয়ই শিক্ষক হিসেবে নিজেকে কতোটা প্রস্তুত করতে পেরেছেন, তা দেখার বিষয়। প্রাথমিকের এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করার জন্য দেশে সরকারি পিটিআই আছে ৬৭টি এবং বেসরকারি ২টি। সেখানকার আবাসন ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা মোট শিক্ষকের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে শিক্ষকরা যথাযথ প্রশিক্ষণ পান না। যার প্রভাব পড়ে শ্রেণি পাঠদানে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে প্রতিনিয়ত, শিক্ষিত হচ্ছে মানুষ। নিরক্ষর মানুষ পাচ্ছে শিক্ষার আলো। তবে কাগজ কলমের হিসাব বলছে ভিন্ন কথা।তাই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে হোক। শিক্ষা হোক জীবনের জন্য। সাক্ষরতা বয়ে আনুক সবার জন্য অনুপম সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির সুবাতাস। সাক্ষরতাকে হাতিয়ার করে দুনিয়ার সব মানুষের জীবন হয়ে উঠুক অনাবিল প্রশান্তির ঠিকানা। শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌহার্দ্যের এ পৃথিবীতে মানুষের জন্য আর কোনো দ্বন্ধ সংঘাত কাম্য নয়। বিশ্বের বুক থেকে ক্ষুধা, দরিদ্রতা ও দুর্নীতি চিরতরে নিপাত যাক। ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষের জন্য কলম, কাগজ আর বই হোক দুর্দিনের হাতিয়ার। সাক্ষরতা হোক দক্ষ হয়ে জীবন তৈরি ও আগামির বিশ্ব গড়ে তোলার দুর্বার ও দুর্জেয় হাতিয়ার।তাই আমাদের জাতীয় অগ্রসরমানতা নতুন পর্যায়ে উন্নীত হোক, আন্তরিকভাবে এ কামনাই করি।
লেখক :কলাম লেখক ও গবেষক,প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।