অবৈধভাবে ইতালী যাত্রা: চার মাস ধরে নিখোঁজ দুই ভাই
মাদারীপুর প্রতিনিধি : মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের পশ্চিম পূয়ালী গ্রামের আপন দুই ভাই মিলন মুন্সি (৩৫) ও আল-আমিন মুন্সি (৩২) নিখোঁজ আছেন। তবে মঙ্গলবার রাতে তাদের মৃত্যুর সংবাদে পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
খোঁজ নিয়ে সরেজমিনে জানা যায়, মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের পশ্চিম পূয়ালী গ্রামের সিরাজ মুন্সির দুই ছেলে মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সি এবং এক মেয়ে লিপি বেগম। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সিও বিয়ে করেছেন। তাদের দুইজনের ঘরেই একটি করে ছেলে সন্তান আছে। বাবা সিরাজ মুন্সি অসুস্থ, তাই কোন কাজ করতে পারেন না। অভাবের সংসারে এই দুই ছেলেই ভরসা। সেই সুযোগটি কাজে লাগান ডাসারের গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরহাদ মাতুব্বর। দালাল ফরহাদ মাতুব্বর ইতালী নেয়ার প্রলোভন দেখান মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সিকে। তার প্রলোভন পড়ে জমি বিক্রি করে, ধান বিক্রি করে, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে ও বিভিন্ন এনজিও (সমিতি) থেকে লোন নিয়ে ৩০ লাখ টাকা তুলে দেন দালাল ফরহাদ মাতুব্বরের হাতে। এরপর গত সাত মাস আগে মার্চ মাসে ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন দুই ভাই মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সি। মাঝপথে লিবিয়া গিয়ে তারা অবস্থান করেন। পরে গত ২৭ এপ্রিল লিবিয়া থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অর্ধশত মানুষের সাথে ইতালীদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন দুইভাই। এরপর থেকে তাদের আর পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। প্রায় চার মাস ধরে কোন সন্ধান পাইনি পরিবার। বার বার দালাল ফরহাদ মাতুব্বরের কাছে গিয়েও কোন সঠিক তথ্য জানতে পারেনি দুইভাইয়ের পরিবার।
এরপর মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে একই উপজেলার তাতিবাড়ি এলাকার ই¯্রাফিল মিয়ার কাছে জানতে পারেন লিবিয়ার ভুমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সি নামের দুই ভাই মারা গেছেন। ই¯্রাফিল লিবিয়াতে মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সির সাথে ছিলেন। গত ২৭ এপ্রিল মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সি একটি নৌকায় ও ই¯্রাফিল মিয়া আরেকটি নৌকায় উঠেছিলেন। মাঝ সাগরে মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সির নৌকাটির তলা ফেটে ডুবে যায়। ই¯্রাফিলের কাছে এই সংবাদ পেয়ে রাতেই পরিবারের লোকজন দালাল ফরহাদ মাতুব্বরের কাছে যান। এসময় দালাল ফরহাদ মাতুব্বর তাদের জানান, ওরা বেচে আছে, ১০ সেপ্টেম্বর ওদের সাথে কথা বলিয়ে দিবো। গত চার মাস ধরে দালাল ফরহাদ কথা বলে দিবে, এই বলে পরিবারের লোকজনকে ঘুরাচ্ছিলেন। তাই দুইভাই বেচে আছেন নাকি মারা গেছেন কিছুই বুঝতে পারছেনা তাদের পরিবার।
বড় ভাই মিলন মুন্সির স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, প্রতি মাসে ৪৭ হাজার টাকার কিস্তি দিতে হয়। ওরা যাবার পর আমরা অনেক অসহায় হয়ে পড়েছি। সেই সাথে প্রতিমাসে এতগুলো টাকা কিস্তি দেয়া আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ছে। গত চারমাস ধরে আমার স্বামী ও দেবরের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। তাদের খোজ খবর জানতে দালাল ফরহাদ মাতুব্বরের কাছে ঘুরতে ঘুরতে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। দালাল ফরহাদ বলেন, আমার স্বামী ও দেবর বেচে আছে। কিন্তু তাদের সাথে কোন যোগাযোগ করিয়ে দেয় না। গতকাল রাতে একজনের মাধ্যমে জানতে পারি আমার স্বামী ও দেবর লিবিয়া থেকে নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেয়ার সময় নৌকার তলা ফেটে মারা গেছে। কিন্তু আমরা এখনও সঠিক খবর জানতে পারিনি, তারা দুইজন বেচে আছে নাকি মারা গেছে।
ছোট ভাই আল-আমিনের স্ত্রী ডালিয়া বেগম বলেন, আমার ১৯ মাস বয়সের ছেলে আবদুল্লাহ আছে। সেই ছেলেকে নিয়ে আমি কি করবো। কিভাবে বেচে থাকবো। চেয়ারম্যান ফারহাদ মাতুব্বরের কাছে ধার-দেনা করে ৩০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিলো। দালাল ফারহাদ মাতুব্বর বলেছিলেন এই টাকা দিয়ে ওদের ইতালী পৌছে দিবে। যতবারই গেইম ঘরে নেয়া হোক না কেন, আর কোন টাকা লাগবে না। যখন গেইম ঘরে ওদের তোলা হলো, তা আমাদের জানানোও হলো না। আমার স্বামী ও ভাসুর বেচে আছে নাকি মরে গেছে, তাও আমরা সঠিকভাবে বলতে পারছিনা। আমরা দালাল ফরহাদের বিচার চাই।
মিলন ও আল-আমিনের মা মায়া বেগম বলেন, ফরহাদ চেয়ারম্যান প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নেয়। তখন বলেছিল, সুন্দরভাবে আমার দুইছেলেকে ইতালী পাঠাবে। কিন্তু এভাবে আমার দুইছেলের মৃত্যুর খবর আসবে, তা ভাবতেও পারিনি। এক সাথে দুই ছেলের মৃত্যুর খবর কোন মা মেনে নিতে পারে না। তবে চেয়ারম্যান বলে ওরা বেচে আছে। যদি বেচেই থাকে, তাহলে গত চার মাস ধরে আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করিয়ে দেয় না কেন।
এছাড়াও মিলন মুন্সি ও আল-আমিন মুন্সির প্রতিবেশী খলিল খানের ছেলে শান্ত খান (২১) নিখোজ আছেন। শান্ত খানও গত সাত মাস আগে ওদের সাথে ইতালী যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। গত চারমাস ধরে শান্ত খানের সাথেও তার পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই। ঐ পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। খোজ নিয়ে আরো জানা যায়, একই ইউনিয়েনর মিলন মুন্সি, আল-আমিন মুন্সি, শান্ত খা, শাহিনসহ মোট ছয়জন নিখোজ আছে।
নিখোজ শান্ত খা এর বাবা খলিল খা বলেন, মিলন মুন্সি ও আল-আমিনের সাথেই আমার ছেলে শান্ত গেছে। দালাল ফরহাদ মাতুব্বরকে ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু গত চারমাস ধরে আমার ছেলের কোন খোজ নেই। ছেলে বেচে আছে নাকি মারা গেছে, কিছুই জানিনা। তবে চেয়ারম্যান বলেছেন, আগামী ১০ তারিখে ছেলের সাথে কথা বলিয়ে দিবেন।
এদিকে এই ঘটনা জানাজানি হলে অভিযুক্ত দালাল ফরহাদ মাতুব্বর পলাতক আছে। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল দিলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
ডাসার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, খবরটি আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তবে ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে এখনো কোন অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ডাসারের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার দাশ বলেন, মিলন ও আল আমিনের পরিবার থেকে এখনো বিষয়টি প্রশাসনকে জানায়নি। তবে, খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে। এছাড়া মানবপাচারের ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
(এএসএ/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৪)