সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সিনথিয়া তাসনিমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে হাসপাতালের দেড় শতাধিক চিকিৎসক-কর্মী গত ২৮ আগস্ট জেলা সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত দিয়েছেন। ডা. সিনথিয়া তাসনিমের শাস্তি দাবিতে সপ্তাহব্যাপী কর্মবিরতি পালনের মধ্যে ২৭ আগস্ট তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। যদিও তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

বাজিতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী পল্টন কুমার রায় জানান, ডা. সিনথিয়া তাসনিম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর। এর আগে তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার জুনারচর ২০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ছিলেন।

বাজিতপুর হাসপাতালে চিকিৎসকসহ মোট কর্মী সংখ্যা ১৭০। ২৮ আগস্ট সিভিল সার্জনের কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রে তাদের মধ্যে ১৫৭ জনই সই করেছেন। এতে বলা হয়, ডা. সিনথিয়া তাসনিম হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ ও অ্যাম্বুলেন্সের জ্বালানির জন্য বরাদ্দ টাকাসহ বিভিন্ন খাতের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্যাথলজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে, ইসিজি বিভাগ ও টিকিট বিক্রি থেকে প্রতি মাসে ৫ লক্ষাধিক টাকা আয় হয়। কিন্তু এই কর্মকর্তা ৩ লাখ টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা নিজে নেন। তাঁর নামে বরাদ্দ গাড়ির জন্য মাসে জ্বালানি (অকটেন) বিল বাবদ ১৭-১৮ হাজার টাকা তোলেন। অথচ মাসে এক দিন কিশোরগঞ্জ যান তিনি। এমনকি এই কর্মকর্তা সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের নামেও নানা উপলক্ষে চিকিৎসক-কর্মচারীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক বলেন, অধস্তন কর্মীদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করেন না ডা. সিনথিয়া। সামান্য অপরাধেই চিকিৎসকদের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ভয় দেখাতেন। এক মিনিট দেরি করলেই হুমকি-ধমকি দিতেন। অথচ নিজে মাসে অনুপস্থিত থাকতেন ১০ দিন।

ওই চিকিৎসকের অভিযোগ, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া থেকে রক্ষা পেতে অনেক চিকিৎসকই টাকা দিয়েছেন ডা. সিনথিয়াকে। কাউকে আবার পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে দিয়ে হাসপাতাল কর্মীদের অপদস্থ করিয়েছেন। করোনার সময় হাসপাতালের স্টাফ ও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের চিকিৎসক মিলিয়ে ৭০-৭৫ জন দায়িত্ব পালন করেন। তারাও যথাযোগ্য সম্মানি পাননি। তাদের নামের বরাদ্দ টাকার জন্য রেজিস্ট্রারে সই রেখে কাউকে অর্ধেক, কাউকে এক-তৃতীয়াংশ টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন। প্রতিবাদ করলে ছাত্রলীগ নেতাদের দিয়ে শাসিয়েছেন। এতে তাঁকে সহায়তা করতেন উপজেলার শিমুলতলা শফিউদ্দিন কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) রাজিব মিয়া। একই কর্মস্থলে ১২ বছর ধরে কর্মরত রাজিব ডা. সিনথিয়া বাজিতপুর আসার পর সারাক্ষণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই থাকতেন। রাজিব ও ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় করোনার সময় লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন ডা. সিনথিয়া।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নিজের পদ ধরে রাখতে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন ওই চিকিৎসা কর্মকর্তা। কয়েকটি সূত্রে তারা বিষয়টি জানতে পেরেছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক তারেক রহমানসহ কয়েকজন কর্মী রোববার এ প্রতিনিধিকে বলেন, এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যদি আবারও দায়িত্বে ফিরে আসেন, তাহলে তাঁর অধীনে কেউ কাজ করবেন না।

এদিকে রবিবার থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. রাবেয়া আক্তার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন ছুটিতে ছিলেন। ফিরে এসে হাসপাতালের কর্মীদের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরেছেন। এখন থেকে সবাই মিলেমিশে কাজ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে ডা. সিনথিয়া তাসনিমের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার ব্যবহৃত ০১৭১৭-৭০৪৯৩২ নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।

কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন সাইফুল ইসলাম জানান, ডা. সিনথিয়া প্রথমে তিন দিনের ছুটি নিয়েছিলেন। পরে চিকিৎসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য তিনি ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছুটি নিয়েছেন। তিনি ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন।

(এসএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৪)