মফিজের ‘ত্রাসের রাজত্ব’
শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : খুন, নির্যাতন, দখলবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, বিরোধী দল দমন এমন কোন দুষ্কর্ম নেই, যা তার অভিধানে নেই। তার কথার বাইরে গেলেই চলে বাড়ি-ঘরে হামলা কিংবা জমি-সম্পদ দখল। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে দু'দফা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ইউনিয়নের ২৭টি গ্রামে চলে তার ত্রাসের রাজত্ব। তার করা অত্যাচার আর নির্যাতনের বীভৎসতার ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন এলাকাবাসী। হাসিনা সরকারের পতন হলেও তার নাম মুখে নিতেও যেন ভয় পান তারা। ইউনিয়নজুড়ে আতংক সৃষ্টিকারী এই চেয়াম্যানের নাম মফিজ উদ্দীন বিশ্বাস। তিনি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। শত শত অভিযোগ থাকলেও এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে থানায় নেই কোন অভিযোগ। পুলিশও যেন রেকর্ডেড কথায় সিমাবদ্ধ, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন।
এলাকাবাসীর ভাষ্য,মফিজ মানেই যেন মূর্তিমান আতংক । যে কারনে হাসিনা সরকারের পতন হলেও চেয়ারম্যানের ক্যাডার বাহিনীর সদস্য ছেলে মিল্টন, ভাতিজা আসলাম, আলামিন, রিপন, রয়েল, শুকুর, মোংলা, ওমর, নাসিম, আলম, ফারুক সহ অন্যান্য ক্যাডাররা এখনো গ্রামে গ্রামে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
জানা গেছে, এলাকার অনেক মানুষ মফিজের অত্যাচার নির্যাতনে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইউনিয়নের ঘুরলেই ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মফিজ উদ্দীন বিশ্বাসের চাঁদাবাজী ও দখলদারীর ভয়াবহ চিত্র চোঁখে পড়ে।
ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মসলেম উদ্দীন জানান, ‘তিনি ১৬ বছর বাড়ি যেতে পারেন না। তিনি ঝিনাইদহ শহরে বসবাস করেন। গ্রামে বসবাসরত তার স্বজনরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের জমি দখল করেছে চেয়ারম্যান মফিজ। দখর আর চাঁদাবাজীর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। রঘুনন্দনপুর গ্রামের খায়রুল হোসেন মোল্লার ৩৫ বিঘা জমির ইটভাটা দখল করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বিশ্বাস। এর আগে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে জেলে পাঠানো হয় বলে পরিবারের অভিযোগ। এখনও তিনি কারাগারে বন্দি। শুধু ইটভাটা দখল করেই ক্ষ্যান্ত হননি তিনি। গ্রামের মানুষের চাষের ২২ বিঘা জমি দখল করে বালি উত্তোলন করে রীতিমত নদী বানিয়ে ফেলেছেন। ১৬ বছর ধরে ওই জমির মালিকরা চাষতো দুরের কথা জমির ধারে কাছেও যেতে পারেনি।’
৭ জানুয়ারীর ভোটের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে নিয়ন্ত্রণাধীন রঘুনন্দনপুর গ্রামের মনিরুজ্জামান সজীবের জৈব সার কারখানায় লুটপাট ও ভাঙচুর করে দখলে নেয় তার পালিত ক্যাডার বাহিনীরা। কারখানায় কাজ করার কারণে শের আলী নামে এক ব্যক্তিকেমেরে হাত ভেঙে দেয়। তিন মাস বন্ধ দখলে রাখার পর তিন লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে কারখানাটি মূল মালিকের কাছে ফেরত দেয় মফিজ চেয়ারম্যান।
বাগুটিয়া গোপালপুর ম্যাধমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ ব্যানিজ্যের অভিযোগও আছে এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। প্রধান শিক্ষক, নিরাপত্তা কর্মী ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ও পিয়ন নিয়োগে প্রায় ৬০ লাখ টাকা আত্নসাৎ করেছেন মফিজ চেয়ারম্যান।
বাদ পড়েনি মসজিদ, মাদ্রাসাও। ১৫ বছর রঘুনন্দনপুর গ্রামের জামে মসজিদ ও হাফেজিয়া মাদ্রাসার কমিটি ভেঙে দায়িত্ব দেন মফিজ চেয়ারম্যানের বড় ভাই মোখলেস বিশ্বাসকে। মোখলেস একাই সভাপতি, সম্পাদক ও ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করে মসজিদ ও মাদ্রাসার ফান্ডে থাকা টাকা আত্নসাৎ করেছেন। সেই মাদ্রাসা এখন বন্ধের পথে।
অভিযোগ রয়েছে, গ্রামের ভেতর কেউ ছোট দোকান দিয়ে ব্যবসা করলেও চেয়ারম্যান ও তার ক্যাডারদের চাঁদা দিতে হতো। চাঁদা না দিলেই দোকান বন্ধ করে দিতো ক্যাডাররা।
মফিজ চেয়ারম্যান তার ছেলে মিল্টনসহ সন্ত্রাসী বাহিনীরা রঘুনন্দনপুর, বকশিপুর, রাইজাদাপুর, ভাণ্ডালীপাড়া এবং আশেপাশের গ্রামগুলোতে মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অভিযোগও স্থানীয়দের।
রঘুনন্দনপুর গ্রামের নগেন চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে শৈলেন কুমার অভিযোগ করেন, ‘জমি বলতে ১০ কাঠা জমি ছিল। সেটি জোরপুর্বক দখল করে বালি উত্তোলন করছেন ইউপি চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বিশ্বাস। সেই ১০ কাঠা জমি এখন ৬০ ফুট গর্ত। একই গ্রামের লুৎফর বিশ্বাসের ছেলে নাজমুলের চার বিঘা, মসিউর রহমানের ছেলে মনোয়ারের ১৫ কাঠা, বিশারত আলীর ছেলে গোলাম সরোয়ারের ২২ শতক, ইদ্রিস আলীর ছেলে মিলনের ১৫ শতক, ইরাদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলীর ১২ শতকসহ প্রায় ২৮ জন কৃষকের ২২ বিঘা জমি দখল করে বালি উত্তোলন করে বিক্রি করছেন।’
গ্রামবাসির অভিযোগ, শৈলকুপা থানা পুলিশের সহায়তায় ইউপি চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বিশ্বাস এই দখলবাজী করে গেছেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি। যে কারণে বাবার তৈরি করা একটা ইটের ঘর থেকে হয়েছেন ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক। করেছেন নামে বেনামে অঢ়েল সম্পদ।
রঘুনন্দনপুর গ্রামের আবুল কাসেম অভিযোগ করেন, ‘২০২১ সালে ইউপি চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বিশ্বাসের ভাতিজা আসলাম তার ৭০ মন শুকনা হলুদ জোর করে নিয়ে যায়, যার মুল্য ৭ লাখ টাকা।’
একই গ্রামের মোহাম্মদ আলী জানান, ‘তিনি হতদরিদ্র মানুষ। অথচ ইউপি চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বিশ্বাস তার লোকজন দিয়ে ৮টি ছাগল ও একটি গরু নিয়ে ভুরিভোজ করে।’
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিচার-শালিস ও তালাক বিয়ের নামেও তিনি উভয় পক্ষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন। রঘুনন্দনপুর গ্রামের মিরা বেগম ও মজনু মিয়ার তালাক ও বিয়ের বিচার করার নামে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন ইউপি চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বিশ্বাস।
গ্রামবাসি বলছেন, মফিজ ইউনিয়ন আ’লীগের যুগ্ম আহবায়ক। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আব্দুল হাইয়ের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। ফলে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও তার টিকি কেউ স্পর্শ করতে পারেনি।
সরকার পতনের পর তিনি পালিয়ে আছেন বলে একটি সুত্র জানায়। এতসত অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দীন বিশ্বাসের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
অসংখ্য মানুষকে অত্যাচার, নির্যাতন, খুন, দখলবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, বিরোধী দল দমন সহ নানা অভিযোগ থাকলেও অদৃশ্য কারণে থানায় কোন অভিযোগ নেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানালেন, ‘চেয়ারম্যান মফিজের বিরুদ্ধে থানায় কোন অভিযোগ নেই। তবে কেউ অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।’
(এসআই/এসপি/সেপ্টেম্বর ০১, ২০২৪)