মোঃ শাজনুস শরীফ, বরগুনা : চুলের কাটিং নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দুদফায় মারামারি ঘটনায় অন্তত ১০/১১জন আহত হয়েছেন। গুরুতর ৬জন আহতের মধ্যে ৫জনই মারামারি মিমাংসা করতে গিয়ে আহত হন।

এমনকি আক্রোশের জেড়ে অপর আরেক ঘটনায় নিখোঁজের ৩দিন পরে মরদেহ উদ্ধার হওয়া সুজন নামের এক যুবক কে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকান্ডের সাথে প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ঘায়েল করতে মরিয়া হয়ে উঠে পরে লেগেছে একটি পক্ষ। তবে জেলা পুলিশের সুযোগ্য চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা বরগুনা সদর সার্কেল আবদুল হালিমের দুরদর্শিতায় মরদেহ উদ্ধারের ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার আগেই হত্যাকান্ডের কারণসহ জড়িতদের সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

বরগুনা সদর উপজেলার ৪ নম্বর কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের জাকিরতবক (ফরাজির পোল) এলাকায় মাত্র দুইশত গজ দুরত্বে পরপর চাঞ্চল্যকর এমন দুটি ঘটনায় পুরো ইউনিয়ন জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। চাঞ্চল্যকর ঘটনা দুটি বর্তমানে টক অফ দ্যা টাউনে পরিনত হয়েছে।

সামান্য দুরত্বে একই এলাকায় পৃথক ঘটনায় আলাদা দুটি মামলা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বরগুনা জেলা পুলিশের বরগুনা সদর সার্কেল আবদুল হালিম।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী নারায়ণগঞ্জ থেকে বরগুনা সদর উপজেলার ৪নম্বর কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নে জাকিরতবক এলাকার ফরাজী বাড়ীতে বেড়াতে আসেন জনৈক দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আরিফ ফরাজী। গত সোমবার (১৯ আগস্ট) আরিফ ফরাজী শর্টপ্যান্ট পরিহিত অবস্থায় পাশ্ববর্তী ঘটবাড়িয়া বাজারে বাজারে গেলে বেশভুষা ও চুলের কাটিং দেখে একটি চায়ের দোকানে বসে আরিফ ফরাজীকে উদ্দেশ্য করে অশালীন মন্তব্য করে স্থানীয় রাজিব ও সজিব নামের দুই যুবক। এসময় উভয়ের মধ্যে তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হলে বরগুনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করে আরিফ।

পরে বিষয়টি বাড়িতে গিয়ে জানালে মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বিকেলে নিজেদের প্রভাবের জানান দিতে পরিকল্পিতভাবে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে ফরাজীবংশের প্রায় দেড় শতাধিক তরুণ যুবক ঘটবাড়িয়া বাজারে জড়ো হয়ে আলিমের ফার্মেসীর সামনে রাস্তার উপরে রাজিব ও সজিবকে ধাওয়া করে। এসময় সজিব দৌড়ে গিয়ে ফার্মেসীর পাশেই কবিরের টেইলার্সের দোকানে আশ্রয় নিলে সীমান্ত বাবু, নিপুন, ফার্মেসী মালিক আলিমসহ আরো কয়েকজন স্থানীয়রা এগিয়ে এসে ফরাজীদের থামাতে চেষ্টা করে। এসময় সজিব মাথায় ধারলো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর জখম হয়।কাকতালীয় ভাবে ওই একই সময়ে আলিমের ফার্মেসীতে ঔষধ কিনতে আসা আবদুল হালিম (আবদুল্লাহ) গন্ডগোল থামাতে এগিয়ে আসলে পিছন থেকে আবদুল্লাহর মাথায় লাকড়ি দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করে দুলাল ফরাজী। জ্ঞান হারিয়ে আবদুল্লাহ রাস্তায় পরে যাওয়া আবদুল্লাহকে মারধরের হাত থেকে বাঁচাতে সীমান্তবাবু এগিয়ে আসলে তাকে পিটিয়ে জখম করা হয়।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী নিপুণ, ফার্মেসী মালিক আবদুল আলিম বলেন, ঘটনার দিন ঘটবাড়িয়া বাজারের রাস্তার পাশে থাকা একটি পেয়ারা গাছের ওখন থেকে ফরাজীরা প্রায় একশো থেকে দেড়শো লোক চলা, বগি দাও, চাকু হাতে সজিবকে ধাওয়া দেয়। সজিব দৌড়ে গিয়ে কবিরের দোকানে উঠলে সেখানে গিয়েও দাও চাকু দিয়ে সাজিবকে উদ্দেশ্য করে কোপ দেয় ফরাজী বাড়ীর লোকজন। সিমান্ত বাবু ভাইসহ আমরা কয়েকজন গিয়ে মারামারি থামাতে চেষ্টা করি। আবদুল ভাই সেও থামাতে আসলে তারে পিছন থেকে চলা দিয়ে পিটান দিলে তার মাথা ফেটে যায়। বাবু ভাইও ব্যাথা পাইছে।

মারামারি থামাতে গিয়ে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকার কারনে সীমান্ত বাবু'র সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

খবর পেয়ে ওইদিনই সন্ধ্যার কিছু সময় আগে আবদুল্লাহ'র স্বজনরা হামলার প্রতিশোধ নিতে জাকিরতবক এলাকার ফরাজী বাড়ির সামনে পাল্টা হামলা চালায়। এসময় পুলিশ ও নৌবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ফারাজী বাড়ীর লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে আবদুল্লাহ'র বসত ঘরের পিছনের দরজা ভেঙে তল্লাশি চালিয়ে নগদ একলক্ষ চুয়ান্ন হাজার চারশত টাকা, পারফিউম, সাবান ও কোরবানির সময়ে ব্যবহৃত দুই-তিনটি ছেনা ও চাকু জব্দ করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এ ঘটনায় আবদুল হলিম ওরফে আবদুল্লাহ, সিমান্ত বাবু,আবদুল আলী, মোঃ আব্দুল হক, দেলোয়ার ফরাজি, বিপ্লব, ইউনুস ফকির, মোঃ সেলিম ফরাজি, আব্দুল করিম,রাজিব ও সজীব গুরুতর আহত হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বরিশালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আহতরা। এ ঘটনায় আরিফ ফরাজীর মা বাদী হয়ে ২৪জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন।

এই ঘটনাস্থলের মাত্র দুইশত গজ দুরত্বে শনিবার (২৪ আগস্ট) জনৈক আবুল খানের বসত ঘরের পিছনের ডোবা থেকে ৩ দিন আগে নিখোঁজ হওয়া সুজন ফরাজী নামের ২৪ বছর বয়সী এক অটোরিকশা চালকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত সুজন ফরাজী স্থানীয় বাক প্রতিবন্ধী বাদল ফরাজীর ছেলে।

মরদেহ উদ্ধারের ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার আগেই নিহত সুজনের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের সনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

এঘটনায় জাকিরতবক এলাকার স্বপনের ছেলে শাওন, মৃত আলম খানের ছেলে রায়হান খান ও তার মা নিলুফা বেগম (নিলু), এন্তাজ ফরাজী মেয়ে রাশিদা বেগম এবং সোহরাব ফরাজীর ছেলে সজিব ফরাজীসহ অজ্ঞাতনামা আসামী করে সোমবার (২৬ আগস্ট) বরগুনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন নিহত সুজনের মা তাসলিমা বেগম। এ মামলায় এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

মামলার এজাহার সূত্রে জানাগেছে, মারামারির ঘটনার একদিন পরে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুরে সুজন ফরাজী নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ঘটনায় শুক্রবার (২৩ আগস্ট) বিকেলে বরগুনা থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করে সুজনের পরিবার। পরেরদিন শনিবার ( ২৪ আগস্ট) বেলা এগারোটার দিকে ফরাজী বাড়ির পাশে জনৈক আলম খানের ঘরের পিছনের ডোবা থেকে থেকে প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে মুখমন্ডল বাঁধা অবস্থায় সুজনের মরদেহ উদ্ধার করে বরগুনা থানা পুলিশ।

এজাহারে বাদী আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের হট্টগোলের মধ্যে বরগুনা সদর রোডের মিলন মটরস নামের একটি শোরুম থেকে ইয়ামাহা ব্রান্ডের গাড়ি চুরি করে ১নম্বর আসামী শাওন। এ ঘটনার এলাকায় প্রকাশ করে দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে অজ্ঞাত আসামীর মাধ্যমে মাদক সেবনের জন্য সুজনকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

ময়নাতদন্তে সুজনের কান ও গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে আঘাতের পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

নিহত সুজনের স্ত্রী লিমা বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিন ফজরের নামাজের পরে মাছের ট্রিপ নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো সুজন, আর বাড়িতে ফেরেনি, দুপুরের পর মোবাইলও বন্ধ ছিলো। একদিন শনিবার আলমের খানের ঘরের পিছনে ডোবায় তার লাশ পাই। আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।

সুজনের মরদেহ উদ্ধারের পরপরই ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকা প্রতিপক্ষ আবদুল্লাহ ও তার পরিবারকে ফাঁসাতে পুলিশ ও গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে হত্যার দায় আবদুল্লাহ ও তার স্বজনকে দিয়ে মিথ্যা বলে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে দুলাল ফরাজী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হানিফ মাতুব্বরসহ ফরাজী বংশের বেশকিছু লোকজন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও লাইভ ভিডিওতেও সুজন হত্যায় আবদুল্লাহ ও স্বজনদের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।

বরগুনা সদর সার্কেল আবদুল হালিম বলেন, চুলের কাটিংয়ের মত সামান্য বিষয় নিয়ে প্রথমে ঘটবাড়িয়া বাজারে ও পরে ফরাজীর পোল এলাকায় দুপক্ষের মারামারিতে বেশকিছু লোক আহত গুরুতর আহত হয়ছে। আহতরা ঢাকা ও বরগুনাসহ বিভিন্নস্থানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এঘটনায় একটি মামলা হয়েছে, আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মারামারির ঘটনার একদিন পরেই ওই এলাকার সুজন ফরাজী নামের এক অটো চালক নিখোঁজ হয়। ৩দিন পরে জাকিরতবক (ফরাজীর পোল) এলাকার আবুল খানের ঘরের পিছনে ডোবা থেকে আমরা সুজনের মরদেহ উদ্ধার করি এবং উদ্ধারের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই দ্রুত সময়ে হত্যার কারণ ও হত্যাকারীদের সনাক্ত করতে সক্ষম হই। ইতিমধ্যে একজন আসামিকে আমরা গ্রেপ্তার করছি। সকল আসামীরা পরিকল্পিতভাবেই সুজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেপ্তার হওয়া ওই আসামি।

(এসএস/এএস/আগস্ট ২৭, ২০২৪)