ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি : ঈশ্বরদীর রূপপুরের অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারী শিক্ষক আমিরুল ইসলামের বাড়ির পাশের অনাবাদি জমিতে অনেকটা গাজর ও ধনিয়া গাছের মতো দেখতে এক ধরনের আগাছা দেখতে পান। এতে সাদা সাদা ফুল হয়, দেখতেও সুন্দর। গত রবিবার একজনকে সাথে নিয়ে আগাছাগুলো কেটে ফেলেন তিনি। এরপর তাদের শরীরে দেখা দেয় চুলকানি। আমিরুল বলেন, আমরা জানতাম না এটা ক্ষতিকর আগাছা। তাই নাকমুখ না ঢেকেই এগুলো কেটে ফেলি। পরে দেখি গা-হাত-পা চুলকাচ্ছে। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফুলে গেছে।

ঈশ্বরদীর সড়ক ও জমির আইল এবং খোলা জায়গা সয়লাব হয়েছে এই বিষাক্ত উদ্ভিদ পার্থেনিয়ামে। এতে হুমকিতে রয়েছে মানবদেহ, ফসল ও গবাদি পশু। ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী-পাবনা, দাশুড়িয়া-মুলাডুলি, বগা মিঞা সড়কসহ প্রধান প্রধান সড়ক এবং ইউনিয়নের বিভিন্ন ছোট-বড়ো সব রাস্তার দুই ধারে ব্যাপকহারে পার্থেনিয়াম দেখা গেছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে এবং অপসারণ বিষয়ে কাউকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠেছে এই ক্ষতিকর আগাছা ।

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সড়কের পাশে চোখে পড়ে এই আগাছা। হঠাৎ দেখলে যে কারো মনে হবে বড় আকারের ধনেগাছ। চিকন সবুজ পাতার ফাঁকে ছোট ছোট সাদা ফুলে আকর্ষণীয় দেখায় গাছগুলো। কয়েক বছর ধরে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার খোলা জায়গা ছাড়াও বাড়ির অঙ্গিনায়ও জন্মাচ্ছে এই আগাছা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ ও কৃষির নীরব ঘাতক আগাছার নাম পার্থেনিয়াম। এটি দ্রুত বংশ বিস্তার করে। ফলে দ্রুতই কৃষিজমিতে এই আগাছা ছড়িয়ে পড়ছে। গবাদি পশু চরানোর সময় এটি গায়ে লাগলে পশুর শরীর ফুলে যায়। এ ছাড়া তীব্র জ্বর, বদহজমসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, পার্থেনিয়াম নামের উদ্ভিদটির আয়ুষ্কাল মাত্র তিন থেকে চার মাস। এর মধ্যে তিনবার ফুল ও বীজ দেয় গাছটি। ফুল হয় সাধারণত গোলাকার, সাদা এবং পিচ্ছিল। বেড়ে ওঠে যত্ন ছাড়াই। প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার বিশেষ সক্ষমতাও রয়েছে। বিষাক্ত পার্থেনিয়াম বেশি নজরে পড়ে রাস্তার দুই পাশে। তবে স্থানীয়দের ধারণা নেই এই গাছের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। কৃষিজমিতে পার্থেনিয়াম যেকোনো ধরনের ফসলের প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমিয়ে দিতে সক্ষম। এটি সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে আখ, কলা, হলুদ, করলা, শিম ক্ষেত। এছাড়া ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন এবং মরিচের ক্ষেত্রে এ আগাছা বীজের অঙ্কুরোদগম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। এমনকি গবাদি পশুর গায়ে লাগলে বা অন্যান্য আগাছার সাথে খেলে তীব্র জ্বর, বদহজমসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে পার্থেনিয়াম খেয়ে গরুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

স্থানীয় কৃষক ফয়জুল ইসলাম জানান, এই গাছ নিয়ে তাঁরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। কারণ এলাকা এই গাছে ভরে গেছে এবং গবাদি পশুও অনেক সময় এই গাছ খেয়ে ফেলে।

চিকিৎসক ডা. আব্দুল বাতেন বলেন, ‘সাইলেন্ট কিলার’ খ্যাত বিষাক্ত পার্থেনিয়াম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে পৌঁছতে পারে, যা থেকে হতে পারে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ থেকে শুরু করে মারণব্যাধি ক্যান্সারও। বিষাক্ত এই আগাছার বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, পার্থেনিয়াম নিয়ন্ত্রণের জন্য এর ক্ষতিকর দিকগুলো কৃষকদের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে। এটি দ্রুত বংশ বিস্তার করে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর পরাগ রেণু বিষাক্ত । যদি গরুতে খায় তাহলে সমস্যা হয়। নিঃশ্বাসের সাথে গেলে মানবদেহে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়ে ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। শরীরে দেখা দেয় এজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়।

তিনি আরও বলেন, এটি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় গাছ কেটে সাথে সাথে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছ কাটার পর যদি কোথায়ও ফেলে রাখা হয়, তাহলে সেখান থেকে আবার বংশ বিস্তার করবে। কৃষকদের আমরা এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং পরিবেশ রক্ষায় এটি নির্মূল করা জরুরি বলে প্রচার চালাচ্ছি। এই আগাছা পরিষ্কারের সময় হাতে গ্লোবস্ বা মোজা, চোখে চশমা থাকলে ভালো হয়। পা ভালো করে ঢেকে রাখতে হবে।

(এসকেকে/এএস/আগস্ট ২৫, ২০২৪)