চৌধুরী আবদুল হান্নান


প্রথমদিকে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের চলমান আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল কিন্ত এক পর্যায়ে “রাজাকার” শব্দটির ব্যবহার বা অপব্যবহার সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিলো।

১৯৭১ এ রাজাকারদের ভয়াবহ নৃশংসতা সকলেরই জানা, কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন, কেউ ইতিহাস থেকে জেনেছেন। আবার বাংলাদেশের ৫৩ বছরে এসে সেই রাজাকার শব্দটি ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিলো, আনবিক বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো, শিশু-কিশোরসহ নিমিষে নিভে গেল শত প্রাণ। আর সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতির তো হিসাবই নেই।

সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের লেখা একটি কবিতার বইয়ের নাম — “আমি শালা রাজাকার”। একাত্তরে কিশোর বয়সে তিনি চোখের সামনে পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে স্বজনদের নির্মমভাবে নিহত হতে দেখেছেন এবং রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় তাঁর বাবাকে, আর ফিরে আসেননি তিনি। বাবার লাশ খুঁজতে খুঁজতে পুরো বাংলাদেশটিই হয়ে গেছে তাঁর বাবার কবরস্হান। সেই থেকে তাঁর লেখার উপজিব্য মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে অবতীর্ণ তিনি।

কত ক্ষোভ আর বেদনা বেদনা থেকে তিনি এই কবিতার বইটি রচনা করেছেন তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

ওই বইয়ের কয়েকটি লাইন এমন —

“তুই রাজাকার” বলেই কিন্ত

গালিটা দিস তোরা

দিন বদলালে বলেই দেখিস

গলায় দিবো ছোরা।

“আমি রাজাকার বলছি” এই নামে আরও একটি বই লিখেছিলেন ব্রাম্মণবাড়িয়ার একজন প্রগতিশীল লেখক, যিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বুঝতে হবে কোন ক্ষোভ থেকে তিনি বইটির এমন নাম দিয়েছিলেন।আক্ষরিক অর্থে তাৎক্ষণিক যা বুঝা যায়, অনেক সময় তা অন্তর্নিহীত অর্থ নয়।

আমরা ওই যে বলি না, লোকটি এখন দু:খের অথৈ সাগরে পড়েছে। দুঃখের কি কোনো সাগর আছে? অল্পবুদ্ধি অবিবেচক লোক বলতেই পারেন — কোথায়? সাগর তো দেখি না। বড়দের ছোট ভুল অনেক সময় বড় প্রলয় ঘটায়।

লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল যখন বলেন, তিনি তাঁর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো দিন যেতে চাইবেন না, ছাত্র-ছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে, এরা হয়তো সেই রাজাকার; আমরা যারপরনেই বিব্রত হই। আমরা বুঝি এটা তার গভীর অভিমানের কথা কিন্ত তাঁর এ কথা আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের তাৎক্ষণিকভাবে আরও ক্ষীপ্ত করে তুললো, আন্দোলনের মূল লক্ষ্য দিকভ্রান্ত হলো।

সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সকল ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় “জাফর ইকবাল স্যার” যদি এখন বলতে চেষ্টা করেন তিনি ওইভাবে বলেননি, তাতে লাভ কি? যে প্রলয় ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। বুঝতে পারি তাঁর বয়স হয়েছে, তিনি রাজনীতিকও নন।

সিনিয়র রাজনীতিক আর সরকারের একাধিক মন্ত্রীর অপরিপক্ক ও অদূরদর্শি কথাবার্তার কারণে একটি সাধারণ আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে নিয়ে গেছে।

এতো মৃত্যুর দায় কার ? প্রতিটি হত্যার বিচার হতে হবে। কিন্ত কে করবে বিচার? সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ আর অভিষাপ তো বৃথা যেতে পারে না।

মানুষ ভালো নেই; বিভিন্ন কারণে মানুষের মনে প্রচন্ড অসন্তোষ জমা হয়েছে। আমানতকারীদের জমানো টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করা হচ্ছে, কোনো প্রতিকার নেই। সাধারণ মানুষদের বঞ্চিত করে দেশের সিংহভাগ সম্পদ চলে গেছে বেনজীর, মতিউরদের দখলে। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, নীরবে আর বসে থাকা যায় না।

এখনই শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আর জনরোষ নিরসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে, জাতির ললাটে কী লিখন আছে তা ধারনা করা যায়।

ইতিহাসের সাক্ষ্য সুখকর নয়, অনেক সময় নির্মম। মাত্র সেদিনের কথা (মার্চ, ২০২২ থেকে নভেম্বর ২০২২) শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ, জনরোষের ভয়াবহতার স্মৃতি আজও ম্লান হয়নি।

উত্তেজিত জনতার ধাওয়া খেয়ে শ্রীলঙ্কান এমপি অমরাকীর্থি দৌঁড়ে পালিয়ে কাছের একটি ভবনের ভেতর আশ্রয় নিলে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ভবনটি ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে এবং পরিণতি বুঝতে পেরে, বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রশে রাস্তায় পদদলিত হয়ে মরার চেয়ে নিজের রিভলবার দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির (১৯১৯ — ১৯৮০) চার দশকের ইরান শাসনের শেষ পরণতি আমরা কী দেখি ?

আন্দোলনের তীব্রতায় শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে জানুয়ারীতে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, আমেরিকায় আশ্রয় নেন। জনরোষ এতটাই তীব্র ছিল যে, ইরানিয়ান রেভুলেশনে পাহলবি রাজতন্ত্র উৎখাতের পর তাদের পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি-সমাধিগুলো ভেঙ্গে গণশৌচাগার বানানো হয়েছিল। কিন্ত ইতিহাসের শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, তবে যে শিক্ষা নেয় আখেরে সে জয়ী হয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।