১ আগস্ট, ১৯৭১
স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : মুক্তিবাহিনী শালদা নদীতে পাকসেনা বোঝাই ৭/৮টি নৌকা এ্যামবুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ৪/৫টি নৌকা পানিতে ডুবে গেলে পাকসেনারা পিছু হটে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে আধ-ঘন্টা গুলি বিনিময় হয়। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৬০/৭০জন সৈন্য হতাহত এবং অনেক রসদ নষ্ট হয়। অপরদিকে হানাদারদের গুলিতে ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও একজন আহত হয়।
১১নং সেক্টরে ‘জেড ফোর্স’ পাকবাহিনীর বাহাদুরবাদ ঘাট অবস্থানের ওপর রকেট লাঞ্চার ও গ্রেনেডের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকবাহিনীর দখলকৃত রেলস্টেশন, রেল বগী, রেল স্টীমার ও জেটির ছাদ এবং পাকসেনাদের অস্ত্ররক্ষিত সকল এলাকা ধ্বংস হয়। পাকসেনারা সম্পূর্ণ পর্যুদস্তু হলে মুক্তিবাহিনীর বাহাদুরবাদ ঘাট দখল করে।
ঢাকার সামরিক আইন আদালত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারী আমিনুল হক বাদশাকে ৬ আগষ্ট বেলা ১০ টার মধ্যে আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। অন্যথায় তার অনুপস্থিতিতে বিচার করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচীতে এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তে সংঘর্ষ চলতে থাকলে পরিণতিতে যুদ্ধ বাঁধতে পারে। তিনি বলেন, আমি আমার সৈন্যকে বলতে পারি না গোলাগুলি বন্ধ কর এবং নীরবে সবকিছু সহ্য করো। দেশরক্ষার জন্য আমি আরেক গাল পেতে দিতে পারি না। আমরা ইতিমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে আভ্যন্তরীণ ও বিদেশী ধ্বংসাত্মক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের আদর্শগত এবং আঞ্চলিক সীমারেখা রক্ষার জন্য সংকল্প ও শক্তি প্রয়োগ করেছি।
শান্তি কমিটির অন্যতম নেতা এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি এ.কিউ.এম,শফিকুল ইসলাম পাকিস্তানের আদর্শ ও অখন্ডতা রক্ষার জন্যে দৃঢ় প্রত্যয় ও সাহসিকতার সঙ্গে সকল প্রকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার আহ্বান জানান। তিনি মুসলিম লীগের সকল গ্রুপকে একত্র করে একটি প্রকৃত জাতীয় সংস্থা রূপে গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।
ঢাকা শহর মুসলিম লীগের এক সভায় মুসলিম লীগ সেক্রেটারী এ.এন.এম.ইউসুফ মুসলিম লীগের প্রতিটি কর্মী ও সদস্যকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে দুষ্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা)-দের দমন করার নির্দেশ দেন।
‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ
........দস্যু সর্দার ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বাহিনী গত চার মাস ধরিয়া বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা ও পৈশাচিক বর্বরতা চালাইয়া আসিতেছে ইতিহাসে উহার নজির সত্যই বিরল। ........ইয়াহিয়া বাহিনীর অত্যাচারের যেমন তুলনা নাই, তেমনি বাংলাদেশের গণ-জাগরণ ও অতুলনীয়। স্বাধীনতার দাবিতে এরূপ একতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সরকার এদেশের জনগণের মধ্য হইতে যতটা বিচ্ছিন্ন ছিল, ইয়াহিয়া শাহী আজ বাংলাদেশের জনগণের সকল শ্রেনী, সকল স্তর হইতে ততোধিক বিচ্ছিন্ন।
...........বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশের বীর জনগণের সংগ্রামকে চ’র্ণ করিয়া দিতে পারে পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নাই। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকামালা বিশ্বজনমত:
............. আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির প্রতিনিধি কর্নেল অ্যার্লা সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর শেষে তার সফর অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতন বায়াফ্রার মর্মান্তিক ঘটনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। দখলকৃত এলাকায় হানাদার সৈন্যরা যে বীভৎস হত্যাকান্ড ও পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তার কোনো নজির নেই।
নরওয়ে রেডক্রসের একজন প্রতিনিধি ভারতের শরনার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে বলেছেন, বর্তমান শরনার্থী সমস্যার সাথে বিশ্ব ইতিহাসের কোনো ঘটনার তুলনা করা যায় না।
............. মার্কিন জনগণ ও সেখানকার পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁদের অকুন্ঠ সমর্থন জানালেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন জঙ্গীশাহীকে অস্ত্র সাহায্যের নীতিতে অবিচল রয়েছেন। মার্কিন সিনেটের বহু প্রভাবশালী সদস্য এ বিষয়ে একমত যে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গী সরকারকে সাহায্য দেয়ার মানেই গণহত্যায় অংশ গ্রহণ করা।
ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারী জন আরউইন সিনেটের এক সাব-কমিটির বৈঠকে বলেছেন যে, বাংলাদেশে দারুন দুর্ভিক্ষের খবর তাঁরা পেয়েছেন। অথচ পাকিস্তানের দখলদার সমর্থকরা দুর্ভিক্ষ রোধের কোনো চেষ্টা চালাচ্ছে না। এতে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, দেশ থেকে ৮০ লাখ মানুষ তাড়িয়ে এবং ১০-১২ লাখ মানুষকে হত্যা করেও এদের কসাই মনেবৃত্তির এখনো খায়েশ মেটেনি।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
(ওএস/এএস/আগস্ট ০১, ২০২৪)