বর্ষায় বাড়ছে শিশুদের ডায়রিয়ার প্রকোপ, প্রয়োজন সচেতনতা
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বাংলা দিনপঞ্জির দ্বিতীয় ঋতুর নাম বর্ষা। আষাঢ় আর শ্রাবণ মাসজুড়ে এ ঋতুর ব্যাপ্তি। বর্ষাকাল মানেই ঝরঝর বৃষ্টির দিন। গৃহবন্দি হন বা অফিসগামী, ছোট শিশু হোক কি বৃদ্ধ—এ সময়ে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে অনেকেরই। সে যেমন পরিবেশগত কারণে, তেমন প্রতিবেশগত কারণেও। তাই প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে ও পরে সারাদেশে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছর সময়ের আরো আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। ডায়রিয়া চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হলো স্যালাইন পানি খাওয়ানো। স্যালাইন হলো বিভিন্ন খনিজ উপাদানসমৃদ্ধ লবণ। স্যালাইন পানি ডায়রিয়া বন্ধ করে না, এটি ডায়রিয়ার ফলে শরীরে যে পানি ও লবণশূন্যতা হয়, তার ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু স্যালাইন পানি তৈরির সঠিক নিয়মাবলী না জানার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এমনকি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবসহ মৃত্যুও হচ্ছে।
গ্রাম বা শহরবাসী—ঝুঁকিতে সবাই প্রতি বছর বন্যার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ডুবে যায় নদী-নালা, খাল-বিল। টিউবয়েলসহ নিরাপদ পানির উৎসগুলোও তলিয়ে যায়। ফলে দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির সংকট। বর্ষাকালে শহরাঞ্চলেও এই সমস্যা তৈরি হয়। বৃষ্টির পানি ড্রেনের নোংরা পানির সঙ্গে মিশে যায়। রাস্তাঘাটে, লোকালয়ে উঠে আসে নোংরা পানি। বিশেষত কাঁচাবাজারগুলো দূষিত পানির সংস্পর্শে আসে বেশি। মাছ-মাংস, শাক-সবজি বা ফলমূল দূষিত পানির সংস্পর্শে এসে আরো বেশি অনিরাপদ হয়ে ওঠে। এসব খাবার বাসায় এনে বিশুদ্ধ না করে খেলে পেটের সমস্যা হয়ে থাকে।
মূলত হেপাটাইটিস এ, রোটা ভাইরাস, কলেরা, স্যালমোনেলা—এসব জীবাণু শিশুর ডায়রিয়ার জন্য দায়ী। আর বর্ষাকাল এসব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়।
ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া
* হেপাটাইটিস এ : দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। এটি যকৃৎকে সংক্রমণ করে। মূলত শিশুরাই এতে আক্রান্ত হয়। এতে জ্বর, বমিভাব, বমি, শারীরিক দুর্বলতা ও পেটব্যথাসহ নানাবিধ জটিলতা হয়।
* রোটা ভাইরাস : ভাইরাসটি সাধারণত নবজাতক শিশুদের আক্রমণ করে। প্রথমে শিশুর পরিপাকতন্ত্র আক্রান্ত হয় এবং পরে ডায়রিয়ায় রূপ নেয়।
* অ্যাডিনো ভাইরাস : শিশুদের ক্ষেত্রে এতে সংক্রমিত হওয়ার হার বেশি। জ্বর-সর্দি-কাশি এর মূল লক্ষণ। তবে এতে সংক্রমিত শিশুর ডায়রিয়ার মতো পেটের সমস্যাও হতে পারে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত ডায়রিয়া
* স্যালমোনেলা : খাবার ও পানির মাধ্যমে এটি ছড়ায়। সাধারণত সালাদ, রান্না না করা খাবার ও দুগ্ধজাতীয় খাবারে এর উপস্থিতি বেশি থাকে। যেসব শিশুরা মুখে আঙুল দেয় তাদের ক্ষেত্রে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
* ই-কোলাই : এটি অন্ত্রের ভেতর প্রাকৃতিকভাবেই থাকে। পানি বা খাদ্যদূষণের কারণে এর দ্বারা পেট সংক্রমিত হতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়ার লক্ষণ
সাধারণত শিশুরা এমনিতেই ঘন ঘন পায়খানা করে থাকে। তাই বারবার মলত্যাগ মানেই ডায়রিয়া—এমনটা ভাবার কারণ নেই। তবে শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে ঘন ঘন মলত্যাগের পাশাপাশি নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিয়ে থাকে।
_ পানির মতো পাতলা মলত্যাগ।
_ স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে মল বেশি দুর্গন্ধযুক্ত।
_ পেটে প্রচণ্ড ব্যথার সঙ্গে পেট কামড়ানো।
_ মলের সঙ্গে রক্ত আসতে পারে।
_ বমি হতে পারে।
_হজমক্ষমতা কমে যায়।
_ খাবারে অনীহা দেখা দেয়।
_প্রস্রাবের বেগ কমে যেতে পারে।
_ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।
_শিশুর ওজন কমে যেতে থাকে।
_ শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং মাত্রাতিরিক্ত কান্নাকাটি করে।
শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে যা করবেন:এ সময় শিশুর যত্নআত্তির ব্যাপারে খুব সচেতন থাকা জরুরি।
* ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে কোনোভাবেই যেন শিশু পানিশূন্যতায় না ভোগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
* শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হলে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
* শিশু যদি স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডাবের পানি, স্যালাইন, ভাতের মাড় প্রভৃতি খাওয়ানো যেতে পারে।
* পাকা কলা খাওয়ালেও উপকার পাওয়া যাবে। চাল, মুরগি, কাঁচকলা দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করে খাওয়াতে পারেন।
* পেটে গ্যাসের সমস্যা বা অ্যালার্জির উদ্রেক করে এমন খাবার, যেমন—গরুর দুধ, বিস্কুট, ভাজাপোড়া প্রভৃতি খাওয়াবেন না।
* প্রোবায়োটিক (টকদই, পনির, কলা প্রভৃতি) খাওয়ানো যেতে পারে।
হোমিও সমাধান
রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা. হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে বর্ষার মৌসুমের শিশুদের ডায়রিয়া রোগ সহ যে কোন জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে সহজে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই।কেননা একসময় আমরা শুনতাম যক্ষা হলে রক্ষা নেই , বর্তমানে শুনতে পাই যক্ষা ভাল হয়। এ সবকিছু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফসল। নানাবিধ রোগ সমূহ হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। সামগ্রিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা হয়। এটিই একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর কষ্টের সমস্ত চিহ্ন এবং উপসর্গগুলি দূর করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়। তাই সঠিক চিকিৎসা পাইতে হইলে অভিজ্ঞ চিকিৎকের পরামর্শ নিন।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্ষার সময় বাইরে থেকে আসলেই সন্তানকে হাত-মুখ ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলুন। এমনকী বাইরের হাতে খাবার ছুঁতেও দেবেন না। নিশ্চিত করুন সে যেন খাওয়ার আগেও ভালো করে হাত পরিষ্কার করে নেয়। এছাড়া এই মৌসুমে অ্যান্টিসেপটিক সাবান দিয়ে সন্তানকে গোসল করান। তাতে জীবাণু থাকবে দূরে। আর সন্তানও থাকবে সুস্থ। এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত সবার।
লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।