সিলেটে প্রায় ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি
দীর্ঘ ২ বছরেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর হয়নি
লতিফ নুতন, সিলেট : সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৬ কিলোমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর তাতে নগর এলাকার কোথাও কোথাও নদীর পানি নগরে প্রবেশ করেছে। আরেকটু বাড়লে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। এরকম পরিস্থিতিতে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত আছে। দীর্ঘ ২ বছরেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর হয়নি।
আজ বুধবার ভোর ছয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় সিলেটে ৮২ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সঙ্গে পাহাড়ি ঢল মিলিয়ে জেলা জুড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে জেলার প্রায় ৭ লাখ মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। তিন নদী ৫ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট বিভাগে ছোট বড় ৩৭ টি নদ-নদী রয়েছে। এসকল নদ-নদীর মধ্যে তিনটি নদী নব্যতা হারিয়ে মরা নদী হিসেবে রুপ নিয়েছে। এই তিনটি নদীর মধ্যে সুরমা নদীর উৎপত্তি স্থল আসামের বোরাক নদীর মহনায় এবং পিয়াইন নদী ভারতের ডাউকি শহরের উমগোট নদী থেকে উৎপত্তি এবং সারি গোয়াইন নামে নদীর উৎপত্তি স্থল মঘালয়ের জৈন্তা পাহাড় থেকে। সিলেট জেলার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা দিয়ে এই তিনটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। যার কারনে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে বারি বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলে এই ৫টি উপজেলায় প্রায়ই আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয় এবং সুরমা নদী জকিগঞ্জ উপজেলা হয়ে সিলেট শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই সিলেট শহরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
বিগত ২০২২ সালে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের ৭০ শতাংশ এলাকা বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই সময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে সিলেট সফরে আসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকতাদের সাথে আলোচনা করে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা থেকে এই অঞ্চলকে রক্ষায় এই সকল নদীর নব্যতা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রায় দীর্ঘ ২ বছর অতিবাহিত হলেও এর কোন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। যার ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমে আবারও এসকল এলাকার সাধারণ মানুষ পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
বিশ্লেষকদের মতে সুরমা, পিয়াইন ও সারি নদীতে চর জেগে উঠায় নদীগুলো তাদের নব্যতা হারিয়েছে। ভারতের মেঘালয় ও আসামে বারি বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা পানি এই নদীগুলো দিয়ে সহজে প্রবাহিত হতে পারেনা যার ফলে আশপাশের এলাকা আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়। এই অঞ্চলের রাস্তাঘাট সহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজার হাজার মানুষ ও গবাদিপশু। এই সমস্যার একমাত্র উপায় এই নদীগুলোর নব্যতা ফিরিয়ে আনা।
২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সুরমা নদীতে ডেজিং এর কাজ শুরু হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যায়। বিগত প্রায় ৩০ বছর থেকে পিয়াইন নদীত ড্রেজিং এর দাবি করে আসছেন এলাকার সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কোন ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষের। সারি গোয়াইন নদীরও এই একি অবস্থা। এর মধ্যে পর্যাপ্ত ব্রীজ- কালভার্ট না দিয়ে অপরিকল্পিত রাস্থা নির্মান করায় পানি প্রভাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গোয়াইনঘাট-রাধানগর রাস্তা, সারিঘাট-গোয়াইনঘাট রাস্তা, সালুটিকর ভোলাগঞ্জ রাস্তা সংস্কার করে উচু করা হলেও পর্যাপ্ত ব্রীজ-কালভার্ট না থাকায় পাহাড়ি ঢলে নেমে আসে পানিতে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের বন্যার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সিলেট সুরমা নদীর খনন কাজ শুরু হয়েছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড এর প্রধান প্রকৌশলী খুশি মহন সরকার এর সাথে আলাপ কালে তিনি বলেন সিলেট বিভাগের ২০টি নদীর নিচু অংশ থেকে খননের পরিকল্পনা রয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের অনুমোদন পেলে আমরা কাজ শুরু করবো। এই মুহূর্তে সারি গোয়াইন ও পিয়াইন নদীর খননের কোন পরিকল্পনা নেই।
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদীর মধ্যে তিনটি নদীর নব্যতা হারিয়ে মরা নদী হিসেবে রুপ নিয়েছে। এই তিনটি নদীর মধ্যে সুরমা নদীর উৎপত্তি স্থল আসামের বোরাক নদীর মহনায় এবং পিয়াইন নদী ভারতের ডাউকি শহরের উমগোট নদী থেকে উৎপত্তি এবং সারি গোয়াইন নামে নদীর উৎপত্তি স্থল মঘালয়ের জৈন্তা পাহাড় থেকে। সিলেট জেলার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা দিয়ে এই তিনটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। যার কারনে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে বারি বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলে এই ৫টি উপজেলায় প্রায়ই আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয় এবং সুরমা নদী জকিগঞ্জ উপজেলা হয়ে সিলেট শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই সিলেট শহরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
সিলেটের জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টি ওয়ার্ড এবং জেলার ১৩ উপজেলার ১১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০২টি ইউনিয়নই বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এতে করে সিটি করপোরেশন ও উপজেলাগুলোর ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৭ জন মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৬২৭টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে উঠেছেন ১৭ হাজার ২৮৫ জন মানুষ।
সিলেট নগরীর এলাকায় অর্ধ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। ১৩ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের সবকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। প্লাবিত হয়েছে উপজেলার ২২৩টি গ্রাম।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে আজ বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১০০ মিলিমিটার।
আজ ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৮২ দশমিক ২ মিলিমিটার। এর মধ্যে ভোর ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৫ মিলিমিটার। আগামী তিন দিন ভারি ও মাঝারি বৃষ্টিপাতের পূর্ভাবাস রয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ্ সজিব হোসেন।
সুরমা নদীর পানি নগর ছুঁই ছুঁই করায় নগরের বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আজ দুপুরে নগরীর কিনব্রিজ সংলগ্ন সুরমা নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে চাঁদনী ঘাটের শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত নদীর পানি উঠে এসেছে। আরেকটু পানি বাড়লেই তা শহরের এই অংশ দিয়ে প্রবেশ করবে। আবার খানিকটা পশ্চিম দিকে এগিয়ে কোতোয়ালি থানা এলাকার পার হয়ে দেখা গেছে সেখানে নদীর পানি রাস্তায় উঠে এসেছে। এ ছাড়া নগরের তোপখানা, সিলেটের সবচেয়ে বড় আড়ৎ ঐতিহ্যবাহী কালিঘাট এলাকা, কাজিরবাজার, কাষ্টঘর, সোবহানীঘাট, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, উপশহর তেরোরতন, যতরপুর, সোনারপাড়া, খাঁর পাড়া, তালতলা, জামতলাসহ বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে আছে। কোতোয়ালী থানা প্রাঙ্গণ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেট কার্যালয় প্রাঙ্গণসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠানের উঠান জলমগ্ন হয়ে আছে।
সিলেটের ১৩ উপজেলার সবকটি বন্যা কবলিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গোয়াইনঘাট উপজেলা। এরপরই আছে কানাইঘাট ও কম্পানীগঞ্জ উপজেলা। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সিলেটের সঙ্গে উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। পাশাপাশি গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সঙ্গে ইউনিয়নগুলোর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলায় এখন চলাচলের একমাত্র নৌকা।
বন্যাকবলিত গোয়াইনঘাট উপজেলার মানুষের পাশে দাঁড়াতে উপজেলা প্রশাসন প্রশংসনীয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনের স্মার্ট কুইক রেসপন্স টিম এবং ৩৩৩ হটলাইনের ইমার্জেন্সি সার্ভিস অ্যান্ড লজিস্টিকস টিমের কাজ প্রশংসিত হচ্ছে। উপজেলার বন্যা দুর্গত এলাকায় কুইক রেস্পন্স টিম ভলান্টিয়াররা নৌকার মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। পাশাপাশি ৩৩৩ ও ৯৯৯ হেল্পলাইনে প্রাপ্ত কলের ভিত্তিতে প্রশাসনের উদ্যোগে বন্যায় পানিবন্দি জনগণকে খাবার ও জরুরি সামগ্রী (পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ঔষধ, শিশু খাদ্য, গো-খাদ্য) পৌঁছে দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন, গোয়াইনঘাটের উদ্যোগে পরিচালিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় তরুণ-যুবকদের অংশগ্রহণে সংগঠিত স্মার্ট কুইক রেস্পন্স ভলান্টিয়ার টিম।
এদিকে বন্যায় কানাইঘাট উপজেলার চতুল-দরবস্ত সড়ক, গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক, কানাইঘাট শাহবাগ সড়ক, সুরইঘাট-কানাইঘাট সড়কের নিচু এলাকা দিয়ে বন্যার পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হওয়ায় সিলেটের সঙ্গে কানাইঘাট সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কানাইঘাট-শাহবাগ সড়কের রামপুরে সম্প্রতি ১ম দফার বন্যায় ভেঙে যাওয়া সড়কের স্থান পানির তীব্র স্রোতে বিশাল আকারে ভেঙে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট, সুরমা, লোভা ও কুশিয়ারা নদীর পানি অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে গেছে। শত শত বাড়ি-ঘর বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
এ ছাড়া কম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া জকিগঞ্জ উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ৪ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।
(এলএন/এসপি/জুন ১৯, ২০২৪)