স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও সাতক্ষীরার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়নি, তৈরি হয়নি স্মৃতিসৌধ
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ভোরে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া সাত শতাধিক শারনার্থীকে বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পাকসেনা সদস্যরা। যারা মারা যায়নি তাদেরকে সেখান থেকে তুলে এনে রাইফেলের ব্যয়নট দিয়ে খুৃচিয়ে খুচিয়ে নির্যাতনের পর মৃত ও জখমীদের তুলে দীনেশ কর্মকারের জমিতে থাকা ডোবায় মাটি চাপা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সাতক্ষীরার সদরের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালায়। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ওইসব বধ্যভ‚মি চিহ্নিত করে সেখানেহ বানানো হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ। ফলে ওইসব গণকবর ও বধ্যভূমির অধিকাংশ এখন জবরদখলকারিদের হাতে।
'৭১ এর বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সুভাষ সরকার জানান, ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মুক্তিকামী মানুষ সাতক্ষীরা শহরের ন্যাশনাল ব্যাংক লুট করে। পরদিন ২০ এপ্রিল বিকেলে বাগেরহাটের কচুয়া, যশোরের মনিরামপুর, কেশবপুর, ডুমুরিয়ার ৯৬ গ্রামসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ভারতে গমনেচ্ছু সাত শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু শরণার্থী বৃষ্টির কারণে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নীচের তলায় আশ্রয় নেয়। সন্ধ্যার পরপরই সেখানে চলে আসে পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা। তারা শরণার্থীদের দোতলায় তুলে দিয়ে নিজেরা নীচের তলায় অবস্থান নেন। পরদিন অর্থাৎ ২১ এপ্রিল ভোরে ওইসব শরনার্থীদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। গুলিতে মারা না যাওয়া লোকদের বেছে বেছে রাইফেলের ব্যয়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মৃত্যুমুখে ফেলে দিয়ে মৃত ও জীবিতদের তুলে নিয়ে দীনেশ কর্মকারের মাটির বাড়ি সংলগ্ন পুকুরের মধ্যে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়। সেখান থেকে বের হয়ে সকাল ১১টার দিকে পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা শহরের কাছারীপাড়ার ক্যাপ্টেন কাজী মসরুত আহম্মেদ এর বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এ সময় ওই বাড়িতে ডিনাম্রাটি চার্জ করা হয়। তারা কাজী ক্যাপ্টেনকে তুলে নিয়ে যায় রেজিষ্ট্রি অফিসের সামনে।
খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন কাজী ক্যাপ্টেনের শ্যালক। পাকসেনারা দুলাভাইকে গুলি করে হত্যার উদ্যোগ নিলে শ্যালক তার জীবন ভিক্ষা চান। একপর্যায়ে শ্যালককে গুলি করার পর কাজী ক্যাপ্টেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘণ্টাব্যাপি সেখানে লাশ পড়ে থাকার পর স্থানীয়রা ওই লাশ দুটি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করে। সেখান থেকে বের হয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ফুড অফিস মোড়ের পুলিন ব্যাণার্জীর বাড়িতে ঢোকে। হানাদাররা ওই বাড়িতে থাকা সরস্বতী প্রতিমা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। পরে ওই বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। বিকেলে খলিলনগরের রাজাকারখ্যাত খালেক মÐল দলবল নিয়ে পুলিন ব্যাণার্জীর বাড়ি দখল করে নেয়।
সুভাষ সরকার আরো জানান, ২১ এপ্রিল আনুমানিক দুপুর দুটোর দিকে শহরের কামাননগরের অ্যাড, কালিপদ রায় চৌধুরীর বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটের কথা জানতে গেলে সিলভার জুবিলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল কাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে কালিপদ র্য়া চৌধুরীর বাড়ি ডিনামইট নিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। বিকেল তিনটার দিকে পাক হানাদাররা শহরের সুলতানপুর পালপাড়ার যুধিষ্টির পালের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ পাল (৫৫), তার ছেলে নগেন্দ্রনাথ পাল (২৪) ও একই পরিবারের শরৎ চন্দ্র পালের ছেলে কৃষ্ণগোপাল পালকে (২০) বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বাটকেখালির রাজাকার আব্দুল গফুরের বাড়ির পাশে খাল পারে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওই দিন সন্ধ্যায় ভারতের বসিরহাটে থাকা তাদের স্বজনরা খবর পেয়ে লাশ দাফন করার উদ্যোগ নেয়।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে মুক্তিকামী মানুষদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন শুরু করে আলবদর ও আল সামস বাহিনীর সদস্যরা। এদের মধ্যে অন্যতম রাজাকার ছিলেন বৈকারীর জহুরুল ইসলাম ওরফে টেক্কা খান, বুলারাটির আব্দুল্লাহ আল বাকী, খলিলনগরের খালেক মণ্ডল, পলাশপোলের রোকনুজ্জামান, কাজী আব্দুর রাজ্জাক, ডিবি খান, শহরের ধোপাপুকুর এলাকার অম্লজীন ডাক্তার খ্যাত নূর মোহাম্মদ, আলিয়্ ামাদ্রাসা এলাকার রেফারী রইচউদ্দিন, কামানগরের সিরাজউদ্দিন (তুফান কোম্পানীর মালিকের বড় ছেলে), কাটিয়ার ফুট্টুু চৌধুরী, নুরুল বাসার,থানাঘাটার বেড়ে খালেক, কদমতলার খোড়া আমীর, বাটকেখালির আব্দুল গফুরসহ কমপক্ষে দুই ডজন ব্যক্তি। এদের হাতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন জিম্মি হয়ে পড়ে। ঘরবাড়ি লুটপাট শেষে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করা হয়।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আরো জানান, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পরবর্তী পাকহানাদার বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে স্থানীয় রাজাকার ও আল সামস বাহিনীর সদস্যরা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে শহরতলীর বাঁকাল, সদর উপজেলার মাহমুদপুরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে মাটির তলায় চাপা দেয়। পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দুই শতাধিক মুক্তিকামী মানুষদের তুলে এনে ঝাউডাঙা ইউনিয়নের গোবিন্দকাটি গ্রামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে গুলি করে ও রাইফেলের ব্যায়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। একইভাবে তারা কলারোয়ার মুরারীকাটি পাল পাড়ায় নয়জন কুম্ভকারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আল সামস ও রাজাকারদের অনেকই মারা গেছেন। আবার অনেকই রয়েছেন কারাগারে। অনেকে বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন।
বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু জানান, ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল, ২১ এপ্রিল ও পরবর্তীতে ব্যাপক গণহত্যার পর শহরের দীনেশ কর্মকারের বাড়ির পাশে, ঝাউডাঙার গোবিন্দকাটি, শহরের সুলতানপুর পালপাড়া, বাকাল, মাহমুদপুর ও কলারোয়ার মুরারীকাটিতে সৃষ্ট বধ্যভ‚মিগুলোর আজো চিহ্নিত করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দীর্ঘ ১৬ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার পরও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ওইসব বধ্যভ‚মিতে কোন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি সাতক্ষীরা সদরে ১০ বছর ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তার কাছে বারবার আবেদন নিবেদন করেও তিনি বধ্যভ‚মি চিহ্নিতকরণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণে কোন উদ্যোগ নেননি। উপরন্তু জিল্লুল হাকিম নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা দীনেশ কর্মকারের জমিতে থাকা বধ্যভূমি নিজের মালিকানা দেখিয়ে বহুতল ভবন বানিয়েছেন। ফলে আগামি প্রজন্মের কাছে বিপন্ন হতে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবীর জানান, সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে দীনেশ কর্মকারের জমিতে থাকা বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মানের কাজ এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠি পাওয়ার পর ৩০ শতক জমির উপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য নকশাসহ জবা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরায় আরো চারটি বধ্যভ‚মি সংরক্ষণ ও সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ব্যাপারে প্রক্রিয়া অব্যহত রয়েছে।
এদিকে ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল সাতক্ষীরা সরকাারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া সাত শতাধিক মুক্তিকামি মানুষকে হত্যা ও রাইফেলের ব্যায়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে জখম করে শহরের দীনেশ কর্মকারের বাড়ির পাশের পুকুরে মাটি চাপা দেওয়া শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রবিবার বিকেলে বধ্যভ‚মি সংলগ্ন জমিতে আলোচনাসভার আয়োজন করে ’৭১ এর বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি।
সংগঠনটির আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সুভাষ সরকারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সাতক্ষীরা ০২ আসনের সাংসদ আশরাফুজ্জামান আশু। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অধ্যাপক আবু আহম্মেদ, সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কিশোরী মোহন সরকার, সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল হামিদ, সাংবাদিক কল্যাণ ব্যাণার্জী, মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত, রঘুনাথ খাঁ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড. আজাহারুল ইসলাম, হারুণ অর রশীদ, অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী,বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. মোস্তফা নুরুল আলম, বাসদ নেতা নিত্যানন্দ সরকার, অ্যাড. খগেন্দ্রনাথ ঘোষ, জাসদ নেতা অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, ওবায়দুস সুলতান বাবলু, অ্যাড. ওসমান গণি, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সম্পাদক স্বপন কুমার শীল, সুশীলনের সমন্বয়কাারি মোঃ মনিরুজ্জামান অ্যাড. ইব্রাহীম লোদী, উদীচির ছিদ্দিকুর রহমান, সুরেশ পাণ্ডে, প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি কর্ণ বিশ্বাস, অদিত্য মল্লিক, আব্দুস সামাদ, প্রমুখ।
বক্তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরতে সরকারি উদ্যোগে ২১ এপ্রিল সাতক্ষীরা গণহত্যা দিবস ঘোষণা ও বধ্যভ‚মি স্মৃতি স্মারক নির্মাণের দাবি জানান। পরে বধ্যভূমিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়।
এর আগে বধ্যভূমিতে প্রতীকি স্মৃতিফলকে বধ্যভ‚মি স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি, জেলা আওয়ামী লীগ, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, বণ ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি, প্রথম আলো বন্ধুসভাসহ বিভিন্ন সংগঠণের পক্ষ থেকে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়।
(আরকে/এএস/এপ্রিল ২১, ২০২৪)