ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি দিবস ২০২৩। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২৯ নভেম্বরকে ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস হিসেবে গ্রহণ করে। এর ঠিক ১০ বছর পরে ১৯৮৭ সালের ২৯ নভেম্বর ‘ইউনাইটেড নেশনস পার্টিশন প্ল্যান ফর প্যালেস্টাইন’ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর থেকেই মুলত এ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিনি সংহতি দিবস’ হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে ফিলিস্তিনকে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ও নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে ফিলিস্তিনি জনগণ যাতে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, সে লক্ষ্য অনুপ্রাণিত করতে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস প্রতিবছর পালিত হয়ে থাকে। ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন পরাধীনতার শৃঙ্খল পরা একটি যুদ্ধাহত দেশ। ইহুদি সাম্রাজ্যবাদ থেকে নিজ দেশ বাঁচাতে যারা প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলছে। ফিলিস্তিনের ইতিহাস থেকে জানা যায় রাষ্ট্রটি এক সময় প্যালেস্টাইন নামেও পরিচিত ছিল। এর লোকসংখ্যা তখন ছিল প্রায় ১০ লাখ। এই লোকসংখ্যার তিন ভাগের দু’ভাগ ছিল আরব জাতিভুক্ত বা মুসলমান, একভাগ ছিল ইহুদি। লীগ অব নেশন্স-এর ম্যান্ডেট অনুসারে চলা ব্রিটিশ শাসনভূক্ত দেশটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদীদের চক্রান্তে ব্রিটিশ রাজ্য প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করা হয় কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরকে আন্তর্জাতিক শহরের মর্যাদা দিয়ে ‘ফিলিস্তিন’ ভূখ-কে আরব ও ইহুদি অধ্যুষিত দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু এ চক্রান্তের ফলে ফিলিস্তিনের একাংশে ইসরায়েল নামে একটি ইহুদী রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন তো দূরের কথা, তারা নিজ আদি নিবাস থেকে বিতাড়িত হতে থাকে। তখন থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আরব ও ইহুদি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, বর্তমানে তা বিশ্ব সংকটের রূপ নিয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য আমাদের বাংলাদেশের ভালোবাসা

অনেক আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ১৯৭২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ইসরায়েল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বাংলাদেশ মেডিক্যাল টিম ও ত্রাণ পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন ইয়াসির আরাফাত।
পৃথিবীর ইতিহাসে ইংরেজদের বেইমানির অগণিত উদাহরণ আছে। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক উদাহরণ হচ্ছে ফিলিস্তিন। ইংরেজরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সময় ফিলিস্তিনি আরবদের কথা দিয়েছিল- তোমরা যদি তুর্কিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই না করো, তবে তোমাদের (সেলফ ডিটারমিনেশন) স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দেব। ওদিকে আরবদের অগোচরে ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যদি তোমরা জার্মানিকে অর্থসাহায্য বন্ধ করে সে অর্থ ইংরেজকে দাও, তবে যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে তোমাদের ‘ন্যাশনাল হোম’ নির্মাণ করতে দেয়া হবে।

ইংরেজদের এই দুমুখো নীতি প্রকাশ পেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে। এই যুদ্ধের আগে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের উসমানিয়া সাম্রাজ্যের অধীন। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তুরস্কের মুসলিম খেলাফত ভেঙে যায় এবং একটি গুলিও খরচ না করে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখল করে নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান ও লেবানন চলে যায় ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের দখলে। ১৯১৭-এর ২ নভেম্বর সে সময়ের ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর একটি চিঠিতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন, যেটা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।

ইউরোপের নানা দেশে ইহুদিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তবে এই বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হতেই দলে দলে ইহুদি আসতে শুরু করল ফিলিস্তিনে। ওদিকে বেইমান ইংরেজ ক্ষমতালিপ্সু ও আরেক বেইমান জাতি ইহুদিদের ইউরোপে রাষ্ট্র তৈরির পক্ষে কখনও সমর্থন দেয়নি। বরং ঝামেলাবাজ ইহুদিদের ঠেলে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।

রোমান সময় থেকে ইহুদিদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সেখানে বাস করত। তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায় বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে পাড়ি জমায় ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশদের সহায়তায় ১৯১৮ সালের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা হয়ে যায় ২০ হাজার। যা ১৯২৩ সালে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার এবং ১৯৩১ সালে ১ লাখ ৮০ হাজারে।

এর মধ্যেই ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ১৯১৮ সালে তৈরি হয় গুপ্ত ইহুদি বাহিনী ‘হাগানাহ’। এই বাহিনী প্রথম দিকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদীদের সহায়তা করত। পরবর্তী সময়ে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। শুধু ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ও ক্ষেত-খামার দখল করেই তারা ক্ষান্ত থাকেনি, জোর করে বিতাড়িতও করত। বাজার ও রাস্তাঘাটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।

ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও হিটলারের কঠোরতায় ১৯৪৮ সালেই ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা হয়ে যায় ৬ লাখ। টনক নড়ে আরবদের। ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফিলিস্তিনি আরবরা বিদ্রোহ শুরু করে। ব্রিটিশ সৈন্যরা ভয়ংকর দমন-পীড়নের মাধ্যমে সে বিদ্রোহ দমন করে কঠোরভাবে। বিবিসির খবরে প্রকাশ, এ সময় ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে রণকুশলী হয়ে ওঠে।

ইহুদিরা সেই রণকৌশল প্রথমে প্রয়োগ করে আরবদের বিরুদ্ধে। এরপর ইহুদি রাষ্ট্র তৈরিতে চাপ সৃষ্টি করার জন্য ব্রিটিশ সৈন্যদের ওপর। ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। হিটলারের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া এক লাখ ইহুদিকে অতিদ্রুত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জায়গা দেয়ার জন্য চাপাচাপি করতে থাকেন। যদিও ব্রিটেন বুঝে গিয়েছিল এত ইহুদিকে তাদের উপনিবেশ ফিলিস্তিনে নিয়ে গেলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। অর্থাৎ ইংরেজ তখন গৃহস্থকে ঘর পাহারা দেয়ার কথা বলে চোরকে চুরি করার অনুমতি দিল।

জাহাজ বোঝাই করে পঙ্গপালের মতো হাজার হাজার ইহুদি এসে আস্তানা গাড়তে থাকে ফিলিস্তিনে। ধীরে ধীরে দখলদার ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। এবার জাতিসংঘের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে শুরু করে ইংরেজরা। ১৯৪৭-এর নভেম্বরে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের, অন্যটি আরবদের জন্য। এই আরব কিন্তু শুধু মুসলিম নয়। এখানে মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিষ্টানসহ অন্য ধর্মের অনুসারীও ছিল।

এটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিতকরণসংক্রান্ত ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৮১ নম্বর প্রস্তাব ছিল। এ প্রস্তাব অনুসারে ফিলিস্তিনের ৪৫ শতাংশ জমি ফিলিস্তিনি এবং ৫৫ শতাংশ জমি ইহুদিদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। অথচ তখন অবধি জোরজবরদস্তি ও সন্ত্রাসী কায়দায় দখল করার পরও ইহুদিরা ছিল মাত্র ১০ শতাংশ জমির মালিক। স্বাভাবিকভাবে এই চক্রান্তকে মেনে নেয়নি ফিলিস্তিন ও অন্যান্য আরব দেশ। জাতিসংঘে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে চাপ দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এই সুযোগে আরবদের মাঝে বিষফোড়া ইহুদি ঢুকিয়ে ফিলিস্তিন থেকে ইংরেজরা সটকে পড়ে ১৯৪৮-এর ১৪ মে। সেদিনই পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গঠিত হয় ইসরায়েল রাষ্ট্র।

পৃথিবী অবাক হয়ে দেখল, কার জমিতে কারা রাষ্ট্র গঠন করেছে! সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তোড়ে ভেসে গেল সব নীতিনৈতিকতা। যদিও আরব দেশগুলো এটা মোটেই মেনে নিতে পারেনি। সে কারণে রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে মিসর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়া সম্মিলিতভাবে ইসরায়েল আক্রমণ করে।

তীব্র লড়াইয়ে ইসরায়েলের পরাজয় তখন ছিল সময়ের ব্যাপার। ইহুদিদের অস্ত্রের মজুতও ফুরিয়ে যায়। আর কিছুটা এগোলেই মিসরীয় বাহিনী তেল আবিব কবজা করে ফেলতে পারত। কিন্তু তখনই ইসরায়েলের সৃষ্টিদাতার মতো ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় জাতিসংঘ। ইহুদি ও আরব দেশগুলোকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি।

হামাস-ইসরায়েল সংঘাত

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ ৫৪ দিনে গড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গাজায় প্রায় ৪০ হাজার টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েল।

রোববার (২৬ নভেম্বর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলার সময় গাজা সরকারের গণমাধ্যমবিষয়ক কার্যালয়ের প্রধান সালামা মারুফ এই তথ্য জানিয়েছেন।গত ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর দিন থেকে এখন পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় প্রায় ৪০ হাজার টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। তাদের নির্বিচার হামলায় গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে।, ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। গাজাকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যেই এমন ‘বর্বরতা’ চালাচ্ছে তারা।আর, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত শিশুর সংখ্যা গত বছর সারাবিশ্বের সব সংঘাতে প্রাণ হারানো শিশুদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। উপত্যকার বৃহত্তম হাসপাতাল আল-শিফা আর সচল নেই। এখন আমাদের জরুরি ভিত্তিতে বড় ধরনের একটি ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। সাত সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা এ হামলায় ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু ও নারী।জানা গেছে, এই যুদ্ধে গাজায় এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ১৫০ শিশু ও ৪ হাজারের বেশি নারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। আর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ গেছে ১ হাজার ২০০ জনের। নিহতদের মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সৈন্য রয়েছে তিন শতাধিক।এদিকে, মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল-হামাসের চারদিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে রোববার (২৬ নভেম্বর) খাদ্য, পানি ও ওষুধসহ দুই শতাধিক ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, গাজায় জিম্মি প্রায় ৫০ শিশু ও নারীকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। আর প্রত্যেক ইসরায়েলির বিনিময়ে তিনজন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিচ্ছে ইসরায়েল।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশসহ মুসলমান প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এবং ‘নিপীড়িত’ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসলেও বড় ধরণের সংকট এলে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না।

এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরায়েলের সাথে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোন ভূমিকা নিতে পারে না।

এবার গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিতে ভয়াবহ হামলার পর নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উভয় পক্ষের আক্রমণে বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে।তাই নিয়ম করে যেমন সূর্য উঠে এবং অস্ত যায়, তেমনি নিয়ম করে তাদের জীবনেও বারবার নির্মমতা নেমে আসে। দশকের পর দশক ধরে তা চলছে। এক সময় তাদের জমি ছিল, মাথার উপরে ছাদ ছিল। সব দখল হয়ে গেছে। সর্বশেষ আশ্রয়টুকুও দখলের পথে।পৃথিবী একটি নির্দয়-নিষ্ঠুর সময় অতিক্রম করছে। এমন সময় আগে কখনো আসেনি—বলা যাবে না। বেশ কয়েকবার এসেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের ইহুদি নিধন, ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। তবে, এবারের নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা ও বর্বরতা একটু ব্যতিক্রমী। সমগ্র পৃথিবী এবারের বর্বরতা-নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে, যা সম্ভবত কখনো এমনভাবে দৃশ্যমান হয়নি।

বলছি ফিলিস্তিনিদের কথা। বলছি বিশ্ব শক্তির সহযোগিতায় ইসরায়েল কর্তৃক সংগঠিত দখল-হত্যা ও নিষ্ঠুরতার কথা।বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধের থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো কোনো দেশের সীমান্তে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় রয়েছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সৌদি-ইয়ামেন যুদ্ধ, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ, চীন-ভারত যুদ্ধ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চলমান। আমেরিকা-আফগানিস্তান যুদ্ধে টানা ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে আমেরিকা ২০২১ সালে সৈন্য গুটিয়ে নিয়েছে। এসব যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে তুঙ্গে থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো এখন বেশ সরগরম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ চলমান বর্তমান পৃথিবীতে চলমান এই ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্রগুলোই আগামীর পৃথিবীতে ভয়াবহ এক সমস্যা সৃষ্টি করবে, যার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে আরেকটা নরকীয় হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এক্ষুণি থামানো দরকার। ফিলিস্তিন-ইসরাইলকে শুধু সমর্থন নয়, তাদের নিজ নিজ অধিকার বুঝিয়ে দেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, ইসরাইল পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। ইসরাইলকে এখন সম্পূর্ণ উৎখাত করে সমস্যা সমাধান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুরুতে ৪৩ শতাংশ ভূমি দিয়ে ফিলিস্তিনকে যে ভূমিখণ্ড দেয়া হয়েছিল সে ফিলিস্তিনকে ৪৩ শতাংশ ভূমিতেই স্বাধীন ফিলিস্তিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। তাদের আরও ভাবা উচিত, সমাজ এক অখণ্ড জিনিস। অনেকগুলো উপাদান নিয়ে সমাজ গঠিত হয়।

পৃথিবীর এক কোণের কোনো সমাজে বিপ্লব হলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এসে ধাক্কা সে যুদ্ধের হাওয়া লাগে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। পুরো পৃথিবীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে। জাতিসংঘের এখনই উচিত স্বাধীন ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়া। এই ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে আরও শক্ত হস্তে দমন করতে হবে, অনেকটা কঠোর হতে হবে। পৃথিবীর মানুষ রাশিয়া-আমেরিকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, রাজনৈতিক স্বার্থে রক্তারক্তি খেলা আর পুনরায় দেখতে চায় না। আর ফিলিস্তিন এই দেশটির সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে আছে। সারাবিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। সেই সাথে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের দোয়া জড়িয়ে আছে। আমার স্মরণ আছে, সেই ছোটবেলাতেও দেখতাম জুম্মার নামায শেষে ইমাম সাহেব উপস্থিত মুসল্লিদের নিয়ে ফিলিস্তিনের জন্য দোয়া করতেন। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষদের জন্য দোয়া করতেন। তখন ইমাম সাহেব এবং উপস্থিত মুসল্লিদের আমীন আমীন শব্দ এবং হুহু করে কান্নার শব্দও আমার কচি মনটাকে নাড়া দিয়ে যেত। এই রক্তারক্তি খেলা বন্ধ হোক। নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ হোক।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।