স্টাফ রিপোর্টার : দিনে দুপুরে সাতক্ষীরা শহর থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা আটকের সত্যতা গোপন রেখে পরের দিন চোখ বেঁধে ডিবি পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের পর দীপ্ত টিভি ও দৈনিক বাংলা ৭১ এর সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে নাশকতা ও চাঁদাবাজির দুটি মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর আট মাস পর একটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দেবহাটা থানার উপপরিদর্শক লাল চাঁদ আলীর দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি মঙ্গলবার আদালতে উপস্থাপন করা হলে আমলী অঅদালত-৩ এর বিচারক মহিদুল ইসলাম তা পর্যালোচনার জন্য আগামি ১২ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন। একইসাথে তিনি সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ’র জামিনের মেয়াদ আগামি ধার্য দিন পর্যন্ত বর্ধিত করেছেন।

ঘটনার বিবরনে জানা যায়, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালী মৌজার চ-ীচরণ ঘোষ ও তাদের শরীকদের ফেলে যাওয়া ১৩২০ বিঘা জমি কাজী গোলোম ওয়ারেশ, আইডিয়ালের ডাঃ নজরুল ইসলাম, সখীপুরের আব্দুস সালামসহ একটি মহল নিয়ম বহির্ভুতভাবে মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে ১৯৫৬ সাল থেকে ভোগ দখল করে আসছিল। পরবর্তীতে জমির মালিক দাবিদাররা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে জমি ইজারা দিয়ে গত ৫০ বছওে ১৫০ কোটি টাকারও টাকা সরকারি রাজস্ব আত্মসাৎ করে বলে সাবেক জিপি অ্যাড. লুৎফর রহমানের অভিযোগ।

২০১০ সালে পারুলিয়ার জনাব আলী ওই জমি খাস করার জন্য সাতক্ষীরার যুগ্ম জেলা জজ -২য় আদালতে মামলা করেন। বিচারক এসএম মাহামুদুর রহমান এক আদেশে জমির মালিক দাবিদারদের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বিনিময় দলিলের অন্য পৃষ্টার সঙ্গে ৬০,৬১ ও ৬২ নং পাতার হাতের লেখার সাথে মিল না থাকা, বয়নামার মূল কপি জমা না দেওয়া, খাল, রাস্তা ও কালভার্ট এসএ রেকর্ডভুক্ত করার আইনগত বৈধতা তুলে ধরে তা তঞ্চকিপূর্ণ জাল বলে উল্লেখ করেন। একইসাথে ওই জমি অ্যাড. চৌধুরী কু-ু বিকাশসহ দুই জনের নামে রিসিভার নিয়োগের নির্দেশ দেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিলেড বিভাগ ওই জমি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দেখভালের দায়িত্ব দেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে জমির মালিক দাবিদাররা সুপ্রিম কোর্টে সিভিল রিভিউ ১৬৮/২১ দাখিল করেন। যাহা সুপ্রিম কোর্টের চলমান ছুটি শেষ হলেই শুনানাী হবে।

সূত্রটি আরো জানায়, ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দেবহাটার সাপমারা খালের দুইপাশ থেকে উচ্ছেদ হওয়া ভূমিহীনসহ বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৮০০ টি ভূমিহীন পরিবার সরকার নিয়ন্ত্রিত খলিশাখালির ১৩২০ বিঘা জমিতে বসবাস শুরু করে। জমিদারদের প্রজা হিসেবে সুনীল স্বর্ণকারসহ সাত জন ওই জমি তাদের নামে রেকর্ডের জন্য আদালতে মামলা করে । যাহা আজো চলমান। জমির মালিক দাবিদাররা ওইসব ভূমিহীনদের নামে দ্রুত বিচার আইনের মামলাসহ কমপক্ষে ২০টি মামলা দেয়।

ভূমিহীনদের উচ্ছেদের জন্য তারা প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করে। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের সস্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক বিশেষ সভায় তৎকালি পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানের বিরোধিতা স্বত্বেও ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে আদালতে একের পর এক পরাজিত হওয়া গোলাম কাজী ও ডাঃ নজরুলদের ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ভূমিহীনদের পক্ষে আনারুল ইসলাম ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি রিট পিটিশন দাখিল করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি শুনানী শেষে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ না করার জন্য স্টাটাসকো দেওয়া হয়। যার মেয়াদ পরবর্তীতে আবারো বাড়ানো হয়। হাইকোর্টেও আদেশ জানতে পেরে জমির মালিকানা দাবিদাররা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করে ভূমিহীনদের ইচ্ছামত ইয়াবা ও অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করাতে থাকেন।

গত বছরের ৪ নভেম্বর সকালে বদরতলা মাসের সেট থেকে পুলিশ ভূমিহীন ইউনুস আলীকে তুলে নিয়ে পারুলিয়া জেলেপাড়ায় অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। ্একই দিনে দ্রুত বিচার আইনে খালাস পাওয়া ১৬ জন ভূমিহীনের তিনজনকে আদালত চত্বর থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে তুলে নিয়ে প্রথমে ডিবি পুলিশ হেফাজতে ও পরে দেবহাটা থানায় নিয়ে যেয়ে নির্যাতন করা হয়। পরদিন তাদেরকে অস্ত্র ও গুলিসহ অস্ত্র ও ডাকাতির চেষ্টার পৃথক দুটি মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। চারজনের বিরুদ্ধে পৃথক দায়েরকৃত তিনটি মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। তবে পুলিশের এহেন আইন বর্হিভুত কর্মকা-ের ঘটনায় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেন সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান। এরপর গত বছরের ১৫ নভেম্বর পুলিশকে দূরে অবস্থান করিয়ে আদালতে পরাজিত জমির মালিক দাবিদাররা ৭৮৫টি ভূমিহীনদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ও লুটপাট করে উচ্ছেদ করে।

বিষয়টি নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানের নির্দেশে সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে শহরের পিএন হাইস্কুলের পাশ থেকে মটর সাইকেল থেকে নামিয়ে অপহরণ করেন সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক আজিজ বিন তারেক ও উপপরিদর্শক লোকমান।(ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষিত) বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে তাকে বিকেলে দেবহাটা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রঘুনাথ খাঁ’র অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ মুখে ক্লুপ আটে। একপর্যায়ে সাংবাদিক কল্যাণ ব্যাণার্জী, বামপন্থী নেতা ও আন্তজার্তিক মানবাধিকার কর্মীদের বিবৃতির মুখে অপহরণের ১০ ঘণ্টা পর ২৩ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে পুলিশ সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁর অবস্থান নিশ্চিত করে। পরদিন তাকে হাতকড়া পরিয়ে বিভিন্নভাবে ভিডিও চিত্র ধারণ করে দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ ওবায়দুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সকাল ১০টার পর রঘুনাথ খাঁকে পুলিশের দায়েরকৃত নাশকতা ও খলিশাখালির কথিত জমির মালিক সুরুজ কাজীর দায়েরকৃত চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চোখ বেঁধে প্রথমে সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি ঘরে (টর্চার সেলে) আটক রেখে চোখ বেঁধে হ্যা-কাপ পরিয়ে পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান ও তার সহযোগী সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর আসাদুজ্জামান, ডিবি ওসি বাবলুর রহমান খান, সদর থানার তৎকালিন পুলিশ পরিদর্শক ও বর্তমানে কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে দুই কানে ইলেকট্রিকশকসহ দুই হাত পিছনে নিয়ে হ্যা-কাপ পরিয়ে দুপায়ের তলায় পিটানোসহ অমানুষিক নির্যাতন করেন। বিকেল ৫টার দিকে তাকে চোখ বেঁধে আদালতে নিয়ে আসা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবদের জন্য আদালতে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন জানানো হয়। পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সাংবাদিক কল্যাণ ব্যাণার্জিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে মানসিক নির্যাতন ও চরম অপমান করা হয়।

এ নিয়ে সাংবাদিক টেরা হাবিব ওরফে বেলচা হাবিব, মনি. জুঁই, নারী নেত্রী জ্যোৎস্না দত্ত, স্বাস্থ্য কর্মী জিমিসহ একটি গ্রুপ পুলিশের সান্নিধ্য পেতে দালালি শুরু করেন। রঘুনাথ খাঁকে নিয়মবহির্ভুতভাবে গ্রেপ্তারের পর নির্যাতন ও মামলার ঘটনায় আন্তজার্তিকভাবে মানবাধিকার কর্মীরা বিবৃতি দিলে পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে শহরের লাবণী মোড়ের প্রিয় গোপাল বস্ত্রালয়ের মালিক জিতেন ঘোষ, তার ছেলে সত্যরঞ্জন ঘোষ ও ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক শ্যামল চৌধুরী পুলিশ সুপারকে বাঁচাতে ম্যানেজ মিশনে নেমে পড়েন। পুলিশ পরিদর্শক তারেক ২৫ জানুয়ারি রঘুনাথ খাঁকে বহনকারি ভাড়ায় চালিত মটর সাইকেল চালক কুদ্দুসকে থানায় ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডাকিয়ে এনে তিনি রঘুনাথ খাঁকে ২৩ জানুয়ারি সকালে খলিশাখালি বিলের ভূমিহীনদের ঘরবাড়ি পোড়ানোর ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করে সুলতানপুর বড়বাজারে সবজি কিনে বাড়ি ফেরার পথে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়নি মর্মে কয়েক দফায় শেখানো বক্তব্য ভিডিও চিত্র ধারণ করেন।

২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর প্রিয় গোপাল বস্ত্রালয়ের মালিক জিতেন ঘোষ পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে সাংবাদিকের বাসায় আসেন। বিষয়টি নিয়ে কোথাও মুখ না খোলার জন্য জোরপূর্বক ওই টাকা সাংবাদিকের বাসায় রেখে চলে যান। এমনকি পুলিশ সুপারের বিপক্ষে না যাওয়ার জন্য সত্যরঞ্জন ঘোষ তার বাবা জিতেন ঘোষের ফোন থেকে সাংবাদিকের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। ২৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে জিতেন ঘোষ ও ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক শ্যৗামল চৌধুরী কারাফটকে যেয়ে সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ’র সঙ্গে দেখা করে পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে মুখ না খোলার জন্য কৌশলে মৃদু হুমকি দেন। ২৯ জানুয়ারি সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ জামিনে মুক্তি পান। ৩০ জানুয়ারি জিতেন ঘোষ সাংবাদিকের সঙ্গে বাসায় দেখা করে পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ না খোলার জন্য হুমকি দেন। পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা রেখে যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ’র চাপে পড়ে পরদিন রাতে জিতেন ঘোষ বহু আপত্তির পর শ্যামল চৌধুরীর উপস্থিতিতে রেখে যাওয়া দুই লাখ টাকা ফেরৎ নিয়ে যেতে বাধ্য হন। যার ভিডিও চিত্র সংরক্ষণ করা হয়।

পরে পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানা যায়, যে পুলিশ সুপারের দেওয়া তিন লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা জিতেন ঘোষ ও শ্যামল চৌধুরী সাংবাদিককে দেওয়ার নাম করে নিজেদের পকেটস্ত করেছেন।তবে জিতেন ঘোষ ও তার ছেলে সত্য ঘোষের বিরুদ্ধে হু-ির ব্যবসা ও বস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধপথে বিশেষ করে কলারোয়ার কেঁড়াগাছি সীমান্ত দিয়ে উন্নত মানের বস্ত্রসামগ্রী চোরাই পথে নিয়ে এসে বছরে এক থেকে দুই বার এলসি’র মাধ্যমে আনা বস্ত্রের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করে মোটা অংকের সরকারি রাজস্ব অনাদায়ের অভিযোগ রয়েছে। জিতেন ঘোষের কোলকাতার নিউ টাউনে বাহারী ফ্লাট, মসলন্দপুর স্টেশনের কাছে ১০ কাঠা জমি রয়েছে বলে একটি দায়িত্বশীল সূত্রের অভিযোগ। যদিও জিতেন ঘোষ সাংবাদিকদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে ইতিপূর্বে বলেছেন, তিনি নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসার কারণে বছরের অর্ধেক সময় ভারতে থাকেন।

এদিকে সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. জিয়াউর রহমান জিয়া জানান, দেবহাটা থানায় রঘুনাথ খাঁসহ চারজনের নামে সুরুজ কাজীর দায়েরকৃত মামলায় পুলিশ সম্প্রতি অভিযোগপত্র দেওয়ার পর তা পর্যালোচনা করার জন্য আগামি ১২ নভেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে। একইসাথে বাড়ানো হয়েছে জামিনের মেয়াদ।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩)