কর্ণফুলী এসিল্যাণ্ডের বিচক্ষণতা
বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ফেরত পাচ্ছেন কোটি টাকার জমি ও ভাতা
জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী’র বিচক্ষণতায় বড়উঠান ইউনিয়নের এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার পাচ্ছেন এক কোটি টাকার মূল্যের জমি ও পূনরায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। এ যেন এক অজানা কাহিনী। ঘটনার ভেতরে অন্য ঘটনার মোড়। মিথ্যার চাঁদরে ঢাকা অতল গহ্বর থেকে এসিল্যাণ্ডের সত্য উম্মোচনের গল্প। তবে এটা কয়লা কুড়াতে গিয়ে সোনা পাওয়ার মতো গল্প নয়, এ যেন ভয়ঙ্কর সুন্দর এক সত্য।
যদিও সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগই ছাড়া সুনাম কম শোনতে পান। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে ব্যতিক্রমও যে রয়েছে তাঁর উদাহরণ কর্ণফুলী এসিল্যাণ্ড। যিনি নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে জনগণের ভরসাস্থলে পরিণত হয়ে ওঠেছেন। নিজের সরকারি দপ্তরকে করে তোলেন জনবান্ধব এক অফিসে রুপান্তর। যার প্রচার বিমূখে হয়তো প্রকাশ পায় কম।
ঘটনাটি হলো ঠিক এ রকম। বেশ কিছু দিন আগে কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসে আর দশটা নামজারি মামলার মতো, একটি নামজারি জমা ভাগের মামলার আবেদন নিয়ে আসেন বড়উঠান ইউনিয়নের স্থানীয় কিছু লোক। জমির চাহিদার পরিমাণ ছিল ৩৭ শতক। জমিটি ছিল নাল। মৌজা বড়উঠান ইউনিয়নের দৌলতপুরে। তদবিরটা ছিলো অছিয়তনামা দলিল দিয়ে তারা নামজারি খতিয়ান করতে চান। তাও আবার বন্দোবস্ত পাওয়া জমি। কিন্তু ভূমি বন্দোবস্ত আইনে স্পষ্টই রয়েছে, এ ধরনের পাওয়া জমি দান বা অছিয়ত করা যায় না। এসিল্যাণ্ডের কাছে আবেদনটি সন্তোষজনক মনে হয়নি। খারিজ করে দেন।
এই ঘটনার কিছু দিন যেতে না যেতেই একই অছিয়তনামা দলিল দিয়ে আবারও নামজারি পাওয়ার আবেদন ও তদবির করেন। কিন্তু আবারও ওই লোকগুলো ভূমি অফিসে হাজির হয়ে জানান, জমির মূল মালিকের কোন ওয়ারিশান/ছেলে সন্তান না থাকায় জমিটি অছিয়ত করে গেছেন। অনেক সময় অছিয়তনামা বিনামূল্যে হয়। কিন্তু জমির মালিক ৮ হাজার টাকা মূল্যে কেন অছিয়ত নামা দলিল করে গেছেন। বিষয়টি এসিল্যাণ্ডের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এর পিছনে কোন না কোন রহস্য থাকতে পারে। নাহয় লোকগুলো তড়িগড়ি করে খতিয়ান করতে চায় কেন?
আবেদনটি প্যান্ডিং রাখলেন কর্ণফুলী এসিল্যাণ্ড। তিনি অফিসে থাকাবস্থায় ফোন করলেন বড়উঠান ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ তৌহিদুল আলম কে। পুরো বিষয়টি ফোনে তহসিলদারকে জানিয়ে তথ্য উপাত্ত প্রেরণ করেন এবং সরেজমিনে খবরাখবর/তদন্ত করতে বলেন। আদৌও জমির প্রকৃত মালিক কে? কোন ওয়ারিশ আছে কি না? কাদের কাছে জমিটির দখল।
সূত্র জানায়, পরের দিনেই বদলে যায় দৃশ্যপট। তহসিলদার সরাসরি স্পটে গিয়ে খুঁজে বের করেন জমিটি দখলে আছেন শেখ আহাম্মদ নামে এক ব্যক্তির ওয়ারিশগণ। খতিয়ানের পেতে আবেদন করেছেন আরেক গ্রুপ। মূল মালিকের ওয়ারিশ রয়েছেন দৌলতপুর। বিষয়টি পরক্ষণেই স্পট থেকেই এসিল্যাণ্ডকে জানানো হয়। তখন এসিল্যাণ্ড নির্দেশ দিলেন মূল ওয়ারিশদের ছবি ও পিতার আইডি কার্ড নিয়ে স্বশরীরে অফিসে আসার। এতক্ষণে খতিয়ান করতে মরিয়া লোকগুলো বিষয়টি জেনে যান। তারা ধামাচাপা দিতে চেষ্টাও করেন। কিন্তু তা না পেরে হতাশ। অফিসে তলদ করলেও তারা আর আসতে রাজি না। এসিল্যাণ্ডের ভয় ভর করেছে তাদের উপর।
এ ঘটনার পরেই তথ্য উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে এসিল্যাণ্ড নিশ্চিত হলেন, ৩৭ শতক জমির প্রকৃত মালিক মো. এখলাছুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি দৌলতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি। বাড়ি বড়উঠান (২নং ওয়ার্ড) ফাজিলখাঁর হাট দৌলতপুর গ্রামের বুধু মাঝির বাড়ি। আরও খোঁজ নিলে তথ্য মিলে, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী কতৃক দেয়া পরিচপত্রে তাঁর মুক্তিবার্তা নং-০২০২০৪০৩৯৬। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত তালিকায় কর্ণফুলী উপজেলায় তাঁর ক্রমিক নং- ৬৫। যার পরিচিতি নম্বর-০১১৫০০০৯৮৬৯। বেসামরিক গেজেট নম্বর-৭৩৬৮। পিতার নাম মৃত কামাল উদ্দিন। মাতার নাম গোল বাহার খাতুন। জাতীয় পরিচয় নং-১৫১৬১১৮৮৮৫১৪৬। জন্ম ১৯৪১ সালের ৬ মার্চ।
পরিবারের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান (মুক্তিযোদ্ধা) এখলাছুর রহমান গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর ওয়ারিশ হিসেবে রেখে যান তৃতীয় স্ত্রী মোছানা বেগম (৪০), এই ঘরে রয়েছে প্রথম কন্যা মিনা আক্তার (১৫), দশম শ্রেণি। দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ এহছান (১৪), ৬ষ্ঠ শ্রেণি। তৃতীয় পুত্র মোহাম্মদ ইয়াছিন (০৮), দ্বিতীয় শ্রেণি ও চতুর্থ কন্যা মেহেরুন্নেছা ইয়াছমিন (০৫) শিশু শ্রেণিতে পড়েন। পূর্বের দুই স্ত্রী নিঃসন্তান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে এলাকার চেয়ারম্যানের ওয়ারিশান সনদে নিশ্চিত করেন। তিনি মারা যাওয়ার ১০ মাস আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও বন্ধ বলে জানান।
এসিল্যাণ্ড পুরো বিষয়টি জেনে, বর্তমান ওয়ারিশদের নামজারি খতিয়ানের আবেদন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। যদিও এরপূর্বে একাধিক সিণ্ডিকেট গ্রুপ জমিটি কিনেছেন বা মরহুম এখলাছুর রহমান অছিয়তনামা দলিল দিয়ে গেছে বলে প্রচার করেছেন। কোটি টাকা মূল্যের জমিটি সুকৌশলে তাদের নামে নামজারি করার চেষ্টা করেন। পরে এসিল্যাণ্ডের বিচক্ষণতায় সত্য উম্মোচন হয়। এ যেন কূল হারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নতুন এক আশ্রয়।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান অনেকদিন বার্ধক্য জনিত ভোগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। পরে দৌলতপুর বহুমূখী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের ওই প্রিয় দপ্তরীর জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে চিকিৎসা করেন। কিন্তু নিয়তির অমোঘ ডাকে ৮১ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান তিনি।
স্ত্রী মোছানা বেগম (৪০) জানান, তাঁর স্বামী মারা যাবার পর থেকে মানে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এই আগষ্ট মাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও তিনি পাননি। উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, ডিসি অফিস থেকে বার বার চিঠি দিলেও তাঁদের খোঁজে পাননি। নিজ জমি ছেড়ে দৌলতপুর রাস্তার ধারে ৪ সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। এসিল্যাণ্ড তাৎক্ষণিক বিষয়টি জেনে, উপজেলা সমাজসেবা অফিস ও সংশ্লিষ্ট দফতরে বিষয়টি জানিয়ে পূনরায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা নেন।
এ বিষয়ে বড়উঠান এলাকার ইউপি সদস্য মো. ফরিদ বলেন, ‘বিষয়টি অকল্পনীয়। কোথা থেকে কি বের হলো আশ্চর্য্য জনক ভাবে। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জীবন দশায় এখলাছুর রহমান ছিলেন দৌলতপুর স্কুলের দপ্তরি। তাঁর নামে সরকার তৎসময়ে ৩৭ শতক জমি বন্দোবস্ত দলিল করে দেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য কোটি টাকার উপরে। ইউপি সদস্য আরও জানান, কর্ণফুলী উপজেলার বর্তমান এসিল্যাণ্ড গত ২০২২ সালের ২৪ মে কর্ণফুলীতে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে সাধারণ মানুষের সেবায় তিনি স্বচ্ছ ও দুর্নীতি মুক্ত ভূমি সেবার মানকে জনকল্যাণে জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দিচ্ছেন। সেবা প্রদানে তাঁর মেধা ও কর্ম দক্ষতায় অল্প সময়ে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন তিনি।’
বড়উঠান ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ তৌহিদুল আলম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমানের জমি যে অন্য জনে খতিয়ান করে নিয়ে যাবে তা কখনো সম্ভব নয়। বিষয়টি এসিল্যাণ্ড স্যারের চোখ ধরা পড়ে। এখন স্যারের দক্ষতায় তিনি জমির খতিয়ান পাবেন। জমি দখলও পাবেন। সম্ভব হলে এই জমিতেই গড়ে তোলা হবে মুক্তিযোদ্ধার বীর নিবাস নামক বাড়ি। আমরা সে চেষ্টায় করব।’
মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান সম্পর্কে জানতে চাইলে দৌলতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নাছির উদ্দীন বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান অত্যন্ত সৎ ও দায়িত্ববান ভালো লোক ছিলেন। ১৯৫৯ সালের পর থেকেই তিনি দৌলতপুর স্কুলে দপ্তরি হিসেবে চাকরি নেন। তবে উনাকে আমরা সবাই অন্যভাবে সম্মান করতাম। কখনো দপ্তরি হিসেবে দেখিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম। বহু কষ্টে জীবন যাপন করেছেন। আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করেছি।’
অন্যদিকে, একজন মুক্তিযোদ্ধা যে গত ৮ মাস যাবত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান না। সে বিষয়ে কতটুকু খোঁজ খবর রাখতেন কর্ণফুলী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। বিষয়টি জানতে মুঠোফোনে কল করা হলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম এন ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সাথে এ বিষয়ে কেউ যোগাযোগ করেনি। আর উনি মারা যাবার পরেই সম্ভবত গেজেট হয়েছে। গত ৮ মাস যাবত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পায়নি বলে কেউ জানায় নি। তবুও যতটুকু সম্ভব যোগাযোগ করব এবং সহযোগিতা করব।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘এটা নিয়ে আমার তেমন বলার কিছু নেই। একটা অছিয়তনামা দিয়ে নামজারি আবেদন করায় কাগজপত্র দেখে বিষয়টি আমার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। কারণ এসব জমি দান করা বা অছিয়ত করা যায় না। তাই শুধুমাত্র তহসিলদারকে বলেছি বিষয়টি তদন্ত করতে। আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন করেছি। কর্ণফুলীতে ভূমি সেবার মানকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আমার মেধা ও কর্ম দক্ষতাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করছি। অন্যদিকে সকল মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, অত্যন্ত গর্ব-গৌরবের বলে মন্তব্য করেন এসিল্যাণ্ড।
(জেজে/এএস/আগস্ট ০৬, ২০২৩)