কর্ণফুলীতে টোকেন-মেসেজেই চলছে সিএনজি
বছরে ৮০ লাখ, কে জড়িত? ট্রাফিক পুলিশ, নাকি সমিতি?
জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার আরাকান মহাসড়ক ও অলিগলিতে সিএনজি এবং ব্যাটারিচালিত অটো-রিকশার দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলছে। জানা যায়, ট্রাফিক পুলিশের ক্ষুদে বার্তা ও কথিত মালিক সমিতির টোকেনেই চলছে এসব সিএনজি ও তিন চাকার নিষিদ্ধ যানবাহন। ছৈয়দ নামে এক ব্যক্তি লেনদেনে সমন্বয় করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়।
সচেতন মহলের দাবি, কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবাধে চলছে এসব যান হতে চাঁদাবাজি।
অথচ, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করেই ট্রাফিক পুলিশের টিআই ও সার্জেন্টসহ কিছু নাম সর্বস্ব মালিক সমিতি ও স্থানীয় নেতাদের মাসিক মাসোহারার যোগসাজসে টোকেনে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যে টাকার একটি অংশ স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পকেটেও যাচ্ছে বলে প্রচার রয়েছে।
তথ্য বলছে, অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত টমটম এবং তিন চাকার রিকশা চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নাম। আরাকান মহাসড়কের মইজ্জ্যারটেক ও শিকলবাহা ক্রসিং গুলোতে মেট্রোপুলিশ ও হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান করলেও স্থানীয়রা বলছে তা নামমাত্র আইওয়াশ। ধরা ছোয়ার বাহিরে এসব যানবাহন বরং সমিতি ও তাদের নির্দিষ্ট টোকনের মাধ্যমে চলছে অবাধে সিএনজি অটোরিকশাসহ নিষিদ্ধ যান।
সূত্র মতে, সিএনজি হতে মাসে ২০০/৩০০ টাকা আদায় করলেও নতুন বছরে বাড়ছে চাঁদার হার। সমিতিগুলোর পক্ষ থেকে বিশেষ স্টিকার লাগিয়ে দিলেও কর্ণফুলীতে অন্য সংস্থার পক্ষ থেকে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে বলে ড্রাইভারদের দাবি।
সিএনজি চালক হানিফ, মামুন ও শফি বলেন, ‘পুলিশকে দেওয়ার কথা বলে শ্রমিক সংগঠনগুলো তুলছে এই টাকা।’ মূলত ঘাটে ঘাটে অর্থ লেনদেনের কারণেই সরকারি নির্দেশনার পরও বন্ধ করা হচ্ছে না এসব যান। যদিও এসব অস্বীকার করে ট্রাফিক পুলিশ বলছেন ভিন্ন কথা। শ্রমিক সংগঠন ও সমিতিগুলো মাসে মাসে একেক রংয়ের এসব স্টিকার কোথায় পায় জানতে চাইলে ড্রাইভাররা বলেন, ট্রাফিক পুলিশই মূলত এসব স্টিকার সমিতিকে দেন। এই টোকেন থাকা মানে মহাসড়কে চলার বৈধতা। আর কোনো বৈধ কাগজপত্র লাগে না তাদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিআরটিএ কিংবা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া এসব টোকেন বিতরণ করছে উপজেলা ভিত্তিক বিভিন্ন সিএনজি-অটোরিকশা মালিক সংগঠন ও শ্রমিক সমিতির নেতাকর্মীরা। এ থেকে মোটা অঙ্কের মাসিক মাসোহারা পায় বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এমনটি অভিযোগ সচেতন মহলেরও। এসব অবৈধ সিএনজি চলাচলে প্রশাসনের ঝামেলা এড়াতে মালিক ও চালকরা প্রশাসনের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে স্থানীয় কিছু নেতাদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট হারে মাসোহারা দিয়ে রাস্তায় চলাচলের বৈধতা কিংবা রুট পারমিট নেন। সেজন্য মাসে সিএনজি প্রতি টাকা দিয়ে টোকেন নিতে হয়।
অনুসন্ধানে আরও ওঠে আসে এসব যানবাহনের টোকেন বাণিজ্যের নেতৃত্বে আছেন ‘চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটো টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন রেজি নং চট্ট-১৪৪১, কর্ণফুলী থানা অটোরিকশা অটো টেম্পো ও চার স্ট্রোক শ্রমিক কল্যাণ বহুমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ রেজি নং-৮৮৮২, কাঞ্চনা ফুলতলা ডলুব্রিজ অটোরিকশা ও সিএনজি মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ রেজি নং-১০৬১৭, গ্রাম অটোরিকশা অটো টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন রেজি নং-চট্ট ১৪৪১, ডলুব্রিজ অটোরিকশা সিএনজি মালিক সমবায় সমিতি রেজি নং ৮০১৫ (১৯৯) ও অঞ্চলভিত্তিক কিছু নেতা।
সিএনজি ড্রাইভারদের দেওয়া তথ্যমতে, কর্ণফুলীতে ‘চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর অধীনে ৮০০’র বেশি সিএনজি ও কর্ণফুলী থানা অটোরিকশা অটোটেম্পো ও চার স্ট্রোক শ্রমিক কল্যাণ বহুমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ-এর রয়েছে ১ হাজার ২০০’র মতো সদস্য। তবে সিএনজি চালায় কম সদস্য। এ হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার টাকা, মাসে ৬ লাখের উপরে এবং বছরে সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ লাখ টাকা শুধু সিএনজি ও অটোরিকশা থেকেই আদায় করা হচ্ছে।
এ টাকা যাচ্ছে কার পকেটে? এ চাঁদাবাজি রুখবে কে? সেটাই সাধারণ জনগণের প্রশ্ন! রশিদে দেখা যায়, পুরাতন ব্রিজঘাটে সিএনজি এসে দাড়ানোর আগেই রশিদ কেটে রাখে ল্যাইনম্যান জকির। তার দেওয়া ১৫ টাকার রশিদে লেখা ল্যাইনমান ৫, এক্সিডেন্ট ফান্ড ৩, মৃত্যু ফান্ড ৭ মোট ১৫ টাকা। নিচে সভাপতি সম্পাদকের ছাপা স্বাক্ষর। চোখে পড়ার মতো একটি লাইন ও নজর কাড়ে ‘ধন্যবাদের সহিত গৃহীত হইল’। অপরদিকে মইজ্জ্যারটেক মোড়ে হানিফের কাটা রশিদে দেখা যায়, ল্যাইনমান ৫, এক্সিডেন্ট ফান্ড ৩, মৃত্যু ফান্ড ৩, কল্যাণ ফান্ড ৪ মোট ১৫ টাকা।
এ প্রসঙ্গে মইজ্জ্যারটেকের ‘চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’ এর নেতাদের সাথে কথা বলতে চাইলেও তারা কেউ সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে রাজি নয়।
তবে কর্ণফুলী থানা অটোরিকশা অটোটেম্পো ও চার স্ট্রোক শ্রমিক কল্যাণ বহুমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ-এর সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে আমাদের কোন লেনদেন নেই। আমাদের সংগঠন বৈধ। কিন্তু মইজ্জ্যারটেকে ইউসুফ নামে যে ব্যক্তি ‘চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’ নামে সিএনজি ড্রাইভারদের কাছ থেকে চাঁদা নেন, তা অবৈধ। এদের কারণে আমাদেরও বদনাম হয়। বিষয়টি ট্রাফিক ও উপজেলা প্রশাসনের দেখা উচিত।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলীর মইজ্জ্যারটেক ট্রাফিক পুলিশ বক্সের (ট্রাফিক ইনচার্জ) টিআই মো. শাহ আরিফ সবৈর্ব অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি ৬ মাস হলো। গত মাসেও ২৪৪ টা গাড়ি আটক করেছি। ৬ মাসে ১৪শ’ থেকে ১৫ শ’ গাড়ি আটক করেছি। এটা যেহেতু উপজেলা বা থানা সিএনজি গাড়িগুলো মইজ্জ্যারটেক হতে ব্রিজঘাটা বা ভেতরের রোডে চলাচল করে। এর জন্য সমিতিগুলো কাকে টাকা দেয় আপনারা খোঁজ নেন। আমরা এসব জানি না। টোকেন দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ কখনো বাণিজ্য করে না।’
কর্ণফুলী উপজেলা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী জানান, ‘টোকেন বাণিজ্য বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিক ও যাত্রী হতে জেনেছি। অনেকবার অভিযান ও করা হয়েছে। পরে আবারও একই অবস্থা দেখা যায়। দ্রুত তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
(জেজে/এসপি/আগস্ট ০৩, ২০২৩)