আমায় ক্ষমা কর পিতা : পর্ব ২'আমি নিশ্চিত, পিতা মুজিব যদি রাষ্ট্রপতির প্রটোকল মেনে বঙ্গভবনে থাকতেন, তাহলে বাঙালির এতো বড় মহাসর্বনাশ কেউ করতে পারত না'
প্রবীর সিকদার
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় দেশেই ছিলাম। পাক হানাদারদের ভয়ংকর অস্ত্র ট্যাংক। কতোবার যে ওই ট্যাংকের নাম শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ট্যাংক দেখা হয়নি। শিশুমনের কল্পনায় কতোবার যে ওই ট্যাংক এঁকেছি! ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। দুপুরের দিকে হবে হয়তো। দিনটি ছিল শুক্রবার। রেডিওতে ‘নাজাত দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে। নাজাত দিবসে জুম্মার নামাজ আদায় করতে মানুষ ছুটছে মসজিদে। অনেকের মধ্যে সে কী বিকৃত উচ্ছ্বাস! এরই এক ফাঁকে আমি গোপনে নারিন্দার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ওয়াড়ি পার হয়ে বঙ্গভবনের উল্টো দিকে হোমিওপ্যাথিক কলেজের সামনে আমি জীবনের প্রথম 'ট্যাংক' দর্শন করেছিলাম। বঙ্গভবনের কোনার সড়কে দাঁড়িয়ে ট্যাংকটি আতংক ছড়াচ্ছিল। সেদিন আমি অনেককেই ওই ট্যাংকের দিকে তাকিয়ে নানা মন্তব্য করতে শুনেছি। পিতা মুজিবের ঘাতক ওই ট্যাংককে আমি বেশি সময় দেখতে পারিনি। সঙ্গোপনে পায়ের কাছে এক চিলতে থুথু ফেলে দ্রুত বাসার দিকে ফিরে এসেছিলাম।
পরে জেনেছিলাম, ওই ট্যাংকে নাকি গোলাবারুদ ছিল না। শুধু আতংক ছড়াতেই ওরা সড়কে নেমেছিল। এরই ফাঁকে ট্যাংকের নিয়ন্ত্রকরা আমার পিতা মুজিবকে সপরিবারে নৃশংসভাবে খুনও করেছিল! বাদ পড়েনি শিশু রাসেলও! কী ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা!
আমার পিতা মুজিবের হত্যাকান্ডকে ‘জায়েজ’ করতে আমি অনেক 'হারামজাদা' পন্ডিতকে মুজিবের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে শুনেছি। কারো কারো লেখাও পত্রিকার পাতায় দেখেছি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, হারামজাদারা যা বলেছে তা তারাও বিশ্বাস করে না। আমার পিতা মুজিবের খুনিদের সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়তেই তাদের ওই বিশেষ গবেষণা! আমার পিতা মুজিবের ত্রুটি-বিচ্যুতি, ভুল-অন্যায়-এ সবই অপপ্রচার, জঘন্য অপপ্রচার।
মুজিবের মহান ত্রুটি, তিনি বাঙালিদের বড় ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। আর ওই ভালোবাসা আর বিশ্বাসে ভর করে রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি প্রটোকল ভঙ্গ করেছিলেন। বঙ্গভবনে না থেকে তিনি থেকেছেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের আটপৌড়ে অরক্ষিত বাড়িতে। আমি নিশ্চিত, পিতা মুজিব যদি প্রটোকল মেনে বঙ্গভবনে থাকতেন তাহলে বাঙালির এতো বড় মহাসর্বনাশ কেউ করতে পারত না। বাংলাদেশ ও বাঙালির বিশাল সম্ভাবনা এভাবে নস্যাত হতো না। পৃথিবীর মানুষ অকালে হারাতো না একজন মহান বিশ্বনেতাকে।
১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫। খুব সকাল থেকেই মেজর ডালিমের বিভৎস ঘোষণা চলছিল রেডিওতে। খুনী ও খুনের দাম্ভিক প্রচারণার পাশাপাশি তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহসহ অনেকেরই আত্মসমর্পনের সকন্ঠ উপস্থাপনা চলছিল। বাসার দেড় শ' টাকার ফিলিপস রেডিওটা বারবার তা শুনিয়ে যাচ্ছিলো। সে কী ভয়ংকর অবস্থা দেশজুড়ে! কাঁদতে পারিনি! ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারিনি! ঘৃণাও নয়! কী অকৃতজ্ঞ, কী কৃতঘ্ন সন্তান আমি!
পিতা মুজিব, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।