আমায় ক্ষমা কর পিতা : পর্ব ১একাত্তরে নিখোঁজ হওয়া পিতার প্রথম মৃত্যু সংবাদ পেলাম পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট!
প্রবীর সিকদার
একাত্তরে আমার চোখের সামনেই নৃশংসভাবে খুন করা হয় কাকা, মামাসহ ১০ স্বজনকে। বাবাকে ধরে নিয়ে যায় ওরা। আর বাবাকে পাইনি। একাত্তরে প্রাণ বাঁচাতে গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিয়েছি, পাড়ি দিয়েছি মাঠের পর মাঠ, নদীর পর নদী। কতো লাশ চোখে পড়েছে। কিন্তু বাবার লাশ পাইনি। বাবাকে যেদিন ওরা ধরে নিয়ে যায় সেদিন বাবার পরনে ছিল নীল রঙের লুঙ্গি। লাশ দেখলেই আমি নীল রঙের লুঙ্গি খুঁজেছি। কিন্তু কোন লাশের পরনে নীল রঙের লুঙ্গি না থাকায় বাবাকে আর পাওয়া হয়নি। সেই থেকে আমার বাবা আমার কাছে একটি ‘নিঁখোজ সংবাদ’।
……যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়…… এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…… বঙ্গবন্ধুর এই ডাকে ঘরে বসেছিলেন না আমার শিক্ষক পিতা ও কাকারা। ছাত্রদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ও যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাদেরই এক ছাত্র লাল মিয়া একাত্তরে যুদ্ধেরই এক পর্যায়ে রাজাকার-বিহারী এনে নৃশংস প্রতিশোধ নিলো। সেই শিশুকাল থেকেই আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পিতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করি। মুজিব বেঁচে থাকলেই দেশ স্বাধীন হবে, লাল মিয়াদের ফাঁসি হবে। তাই তো একাত্তরে আমার কাছে নিখোঁজ পিতার চেয়ে অনেক বেশী অর্থপূর্ণ ছিলো পিতা মুজিবের বেঁচে থাকার বিষয়টি।
একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। দেশে ফিরলেন পিতা মুজিব। সারাদেশ আনন্দ আর অশ্রুবন্যায় ভেসে গেল। আমার শিশু মনের চেতনায় ‘নিখোঁজ পিতা’ হারিয়ে গেলেন পিতা মুজিবের অস্তিত্বে। সব হারানো আমি যেন ফিরে পেলাম তারও অনেক অনেক বেশী!
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। খুব সকালে ঢাকার নারিন্দার একটি মুদি দোকান থেকে সাড়ে তিন টাকা দিয়ে এক সের চাল কিনে পাশেই মামার বাসায় ফিরছিলাম। পাশের বাসার এক কাকা আমাকে রাস্তায় দাড় করিয়ে জানালেন, 'তোগো মজিবররে গুষ্টি সুইদ্যা খুন করা অইছে।' মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ধীরে ধীরে অবিশ্বাসের আবরণ খসে পড়লো। পিতা মুজিব সত্যি সত্যি আর নেই! এই প্রথম আমি একাত্তরে 'নিখোঁজ পিতা'র মৃত্যু সংবাদ পেলাম।
একাত্তরে ওরা চোখে বেয়নেট উঁচিয়ে কাঁদতে দেয়নি। পঁচাত্তরে 'নাজাত দিবস' -এর ডামাডোলে কে শত্রু আর কে মিত্র তা বুঝতে না পারায় কাঁদা হয়নি। অকৃতজ্ঞ শুধু নয়, কৃতঘ্ন সন্তান আমি!
পিতা মুজিব, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।