ভোলার তজুমদ্দিনে মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতি
চপল রায়, ভোলা : ভোলার তজুমদ্দিনে ভূমিহীন গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দেয়া মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণে ব্যপক দূর্নীতি, অবহেলা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার কেয়ামূল্যাহ, সোনাপুর,গুরিন্দা ও চাঁচরা ইউনিয়নে চতুর্থ পর্যায়ে সর্বমোট তিনশোটি সেমিপাকা ঘরের নির্মাণ কাজ চলছে। প্রতিটি সেমিপাকা ঘরের নির্মাণ বাবদ যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লক্ষ চুরাশি হাজার পাঁচশো টাকা। এতে নিম্নমানের ইট, কাঠ সহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিনে উপজেলার কেয়ামুল্যায় নির্মাণাধীন বিয়াল্লিশটি ঘরের সাইটে গিয়ে দেখা যায়, নিম্নমানের আধাপোড়া ইট দিয়ে চলছে গাঁথুনি। জানতে চাইলে কর্তব্যরত রাজমিস্ত্রী দু'নম্বর ইট দিয়ে গাঁথুনি করার কথা স্বীকার করেন। ফ্লোরে সাজিয়ে রাখা দুই নম্বর ইট কি কাজে লাগানো হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে হান্নান রাজমিস্ত্রি বলেন, এগুলো ফ্লোরে সলিং এ লাগানো হবে। অথচ সরকারি এস্টিমেট ও বর্ননায় সবক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির ইট ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে।
পাশেই পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের গাঁথুনির জন্য সিমেন্ট ও বালি মেশানো হচ্ছিল। সিমেন্ট ও বালির অনুপাত কত জানতে চাইলে এ কাজে থাকা নির্মাণ শ্রমিক জানান, তাদেরকে সেলিম কন্ট্রাক্টর ১ বস্তা সিমেন্ট এর সাথে ছয় বস্তা বালি মেশাতে নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবেই তারা গাঁথুনির জন্য সিমেন্ট ও বালি মিশিয়েছেন। অথচ ধার্য্যকৃত এস্টিমেট এ এক বস্তা সিমেন্ট এর সাথে সর্বোচ্চ চার বস্তা তথা (১:৪) অনুপাতে বালি মেশাতে নির্দেশনা রয়েছে। সাংবাদিক দেখে উক্ত সাইটের দেখাশোনায় নিয়োজিত জনৈক হান্নান রাজমিস্ত্রী এগিয়ে এসে ওই শ্রমিককে ধমক দেন এবং বিষয়টি ধামাচাপার চেষ্টা করেন। একইভাবে সিমেন্ট অনুপাতে বালির পরিমাণ বেশি দেয়ায় গতবছর হস্তান্তরিত ঘরগুলোর মেঝে থেকে প্লাস্টার খসে গিয়ে ব্যবহার করতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানায় সেখানকার বাসিন্দারা।
এদিকে এ সাইটের কয়েকটি ঘরের গ্রেডবিমে সরকারি ধার্য্যকৃত বারো মি.মি. রডের পরিবর্তে দশ মি.মি. রড ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি মুঠোফোনে দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত হান্নান রাজমিস্ত্রী ওরফে হান্নান কন্ট্রাক্টর কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ইউ এন ও স্যার যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবেই তারা কাজ করছেন। তাছাড়া ছয় ইঞ্চি পরপর রিং/টাই রড বাঁধার কথা থাকলেও কলাম ও গ্রেডবিমে সাত ইঞ্চি বা ততোধিক দূরত্বে টাই রড বেঁধে ঢালাই করা হয়েছে।
তজুমদ্দিন উপজেলায় এস্টিমেট এ ধার্য্যকৃত মেহগনি কাঠের সহজপ্রাপ্যতা থাকলেও রহস্যজনকভাবে নিম্নমানের রেইনট্রি কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। চাঁচরা, গুরিন্দা, কেয়ামুল্যাহ ও চাঁদপুর ১ নং ওয়ার্ডের নির্মানাধীন ঘরগুলোতে সরেজমিনে দেখা যায়, সারবিহীন তথা সাদা ও বাকলযুক্ত রেইনট্রি কাঠ ঘরের চালায় দেয়া হয়েছে। অথচ এস্টিমেট এ মেহগনি, শিশু, শিলকড়ই,শাল কিংবা সমমানের বাকলবিহীন মসৃণ কাঠ ব্যবহার করতে নির্দেশিত রয়েছে।
উপজেলার চাঁচরা ইউনিয়নে নির্মাণাধীন ঘরের সাইটে গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, গতবছর হস্তান্তরিত ও বর্তমানে নির্মাণাধীন অনেক ঘরে চাঁচরা ইউনিয়নের আবু তাহের চেয়ারম্যান এর মালিকানাধীন মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত ৫০৫ ব্র্যান্ডের অনুমোদনহীন, অবৈধ ইটভাটার নিম্নমানের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এ ভাটায় মেঘনা নদীর তীর থেকে এক্সক্যাভেটর দিয়ে টপ সয়েল কেটে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পুড়িয়ে ও জিগজাগ চিমনির পরিবর্তে ড্রামশিট ব্যবহার করে তৈরি লবনাক্ত মাটি দিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। বেড়িবাঁধের বাইরের নদীর তীরের লবনাক্ত মাটির এ ইটে দ্রুত শেওলা পরে প্লাস্টার খসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাছাড়া সিমেন্ট অনুপাতে কম ব্যবহার করায় হস্তান্তরের পূর্বেই অধিকাংশ ঘরের পুরো বারান্দায় ছোট ছোট ফাটল দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বালির সাথে সিমেন্ট কম পরিমাণে ব্যবহার করায় এমনটি ঘটেছে। এছাড়া প্রতিটি সেমিপাকা ঘরের কাঠামোয় বাকলযুক্ত ও অসমপুরুত্বের নিম্নমানের রেইনট্রি কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, প্রতিটি ঘরে চালার প্রান্তে টিনের দৈর্ঘ্য প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় সামান্য বাতাস বৃষ্টিতে ঘরে ঢুকে পরছে পানি। এমনকি চাঁদপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ব্লক বেরীবাঁধের পাশের সাইটে গিয়ে দেখা যায় এক ঘর থেকে অপর ঘরের দূরত্ব সরকার নির্দেশিত দশ ফুটের অনেক কম রাখা হয়েছে যা সরকারি নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ন প্রকল্পের ক্রয় কমিটিতে দুজন প্রকৌশলীসহ পাঁচজন থাকলেও রহস্যজনকভাবে ইউএনও মরিয়ম বেগম প্রভাব খাটিয়ে কারো সাথে পরামর্শ না করে কমিটির অন্য সবাইকে পাশ কাটিয়ে একাই সবকিছু ক্রয় করে অনভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রীদের দিয়ে নির্মাণ সম্পন্ন করছেন।
এদিকে নির্মাণাধীন এ ঘরগুলোর বিস্তারিত এস্টিমেট এর একুশটি অংশের প্রত্যেকটিতে ইঞ্জিনিয়ার ইন চার্জ এর সরাসরি নির্দেশনায় সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে কোন ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করেছিলাম তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মরিয়ম বেগম এর সাথে কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং এই বিষয়ে কোন বক্তব্য দেন নি। যদিও অভিযোগ সরাসরি তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তার নির্দেশেই হচ্ছে এসব কাজ।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সীমাহীন এ ধরনের অনয়ম ও দূর্নীতির ব্যাপারে অচিরেই দূর্নীতি দমন কমিশনে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করা হবে বলে জানান এলাকাবাসীদের কয়েকজন ।
মুজিববর্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রদত্ত এ সেমিপাকা ঘরের নির্মাণ কাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কোন খুঁটির জোরে এতটা অনিয়ম ও তাচ্ছিল্যের সাথে সম্পন্ন হচ্ছে এমন প্রশ্ন ঘুরছে জনমনে। সহায় সম্বলহীন মানুষের স্বপ্নের ঠিকানায় এ ধরনের নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় একদিকে যেমন হতবাক হয়েছে সচেতন মহল তেমনি উপকারভোগীদের ভবিষ্যতের ঠিকানা গড়তে ছিনিমিনি খেলায় চরম ব্যথিত হয়েছে ভূমিহীন ও গৃহহীন এ পরিবারগুলো। এর প্রতিকার কি পাবে ছিন্নমূল এ মানুষগুলো নাকি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে এ মহৎ কাজে অনিয়মের সাথে জড়িত কুশীলবরা?
(সিআর/এসপি/জুলাই ০২, ২০২৩)