স্টাফ রিপোর্টার : ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বীর নিবাস হস্তান্তর করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান লেখক গবেষক আবীর আহাদ বলেছেন, গত ২ বছর পূর্বে সরকারের 'জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ' ৩০ হাজার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যে বিনামূল্যে "বীর নিবাস" প্রকল্প অনুমোদন করেছিলেন। মাঝখানে একটি বছর অতিবাহিত হওয়ার পর অদ্য ১৫ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্ররণালয়ের তত্ত্বাবধানে সম্প্রতি নির্মিত ৫ হাজার বীর নিবাস প্রাপকদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। মূলত: বীর নিবাস প্রকল্প মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তেমন কোনো গ্রহণযোগ্য প্রকল্প নয়। কারণ সরকারি তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৭০/৭৫% ভাগ দারিদ্রসীমার মধ্যে অবস্থান করছেন; তাদের নিজস্ব কোনো বাড়িঘর নেই। তারা এখন জীবনের শেষপ্রান্তে চলে এসেছেন। তাই এত বিরাটসংখ্যক গৃহহীন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বীর নিবাস দেয়ার কর্মসূচি হাতে নেয়া হলে তাদের অনেকেই বীর নিবাস দেখে যেতে পারবেন না। ফলে এধরনের কর্মসূচি বাস্তবসম্মত নয়। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি, অদূরদর্শিতা, অযোগ্যতা ও হীনম্মন্যতার কারণে তথাকথিত বীর নিবাস প্রকল্প কোনোদিন আলোর মুখ দেখবে বলেও মনে হয় না। বিনামূল্যের করুণানির্ভর ও ঠিকাদার-প্রকৌশলীদের জোড়াতালির বীর নিবাস আর নয়, প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা কেটে নেয়ার শর্তে বিনাসুদে ২৫ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদান করুন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের বীর নিবাস প্রকল্পের নকশা অনুসরণ করে নিজেরাই বাড়ি নির্মাণ করে নেবেন।

আজ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করে আবীর আহাদ প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গত বছর ১৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি করে দেয়া হবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বাহাদুর ঘোষণা দেয়ার পর উপজেলায় উপজেলায় যে বাণিজ্যিক ধান্দা শুরু হয়েছিলো, সেটাও ছিলো মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নির্মম এক তামাশা! দেশের সিংহভাগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা চলে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছেন। এ অবস্থায় ঐ তথাকথিত ১৪/৩০ হাজার তথাকথিত বীর নিবাস কারা কীভাবে কখন পাবেন তাও আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয়। তাছাড়া এই বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে সেজন্য কতোটি বছর অতিবাহিত হবে এবং ততোদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন কিনা তা কি কেউ বলতে পারবেন? এ-ব্যতীত প্রত্যেক উপজেলায় প্রকৃতই গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি খরচে নির্মিত বাড়ি পাবেন, তারও কী কোনো নিশ্চয়তা আছে? অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে একশ্রেণীর প্রতারকচক্র স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে পর্দার অন্তরালে সর্বোচ্চ ঘুষদাতা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিমও গ্রহণ করেছে! এ-প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিযোগিতায় কোনো প্রকৃতই গৃহহীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা নয়, বাড়িগুলো পাবে টাকাওয়ালা ও রাজনৈতিক যোগাযোগের অবস্থাসম্পন্ন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে তথাকথিত সরকারি বীর নিবাস প্রাপকদের যে তালিকা সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছিলো তার মধ্যে উপরোক্ত আশংকার সত্যতা পাওয়া গেছে। সুতরাং বিনামূল্যের তথাকথিত বীরনিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহঋণের অর্থ প্রদান করুন।

আবীর আহাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীবাহাদুর এ পর্যন্ত যতোগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কী পরিমাণ বাস্তবায়ন ঘটেছে তা তিনি না জানলেও আমরা জানি। তাঁর কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়িত হয়নি। তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ফাঁপা বুলিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে দেশটি স্বাধীন হয়েছে বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি তিনি তাই হয়েছেন, হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন। অতএব জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকেই সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়াদের উচ্ছেদ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে ; সামাজিক নিরাপত্তাসহ তাদের ন্যূনতম আর্থসামাজিক উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তাদের জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে।

আবীর আহাদ বলেন, বীর নিবাস হস্তান্তর অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপরোক্ত কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছেন যে, জাতির পিতার কন্যা হিশেবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মানবেতর জীবনযাপন করবেন, গৃহহীন থাকবেন, কেউ কেউ রিকসা চালাবেন, তা তিনি সহ্য করবেন না। প্রধানমন্ত্রীর এ মানবিক প্রত্যয়ের জন্যে তাঁর প্রতি আমরা গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

সরকারের প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের নানান সমস্যা ও গৃহঋণের রূপরেখা তুলে ধরে আবীর আহাদ বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বেকার সন্তানদের বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি চাকরি প্রদান, বাজার মূল্যের সাথে সংগতি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বৃদ্ধিসহ মাসিক ভাতা সাথে প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাসে ১০ হাজার টাকা চিকিৎসা ভাতা প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি। যা করার তা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিতকালের মধ্যেই করতে হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে আর তেমন বেশি দিন বাঁচবেন বলে মনে হয় না। এছাড়া তথাকথিত ৩০/১৪ হাজার বীর নিবাস বরাদ্দকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে টানাপোড়েনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে চরম রেষারেষি ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সব মুক্তিযোদ্ধাই তো এ-সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকারী। সবাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে গিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ ছোটো বা কেউ বড়ো মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই। সবাই মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি দিতে হলে সবাইকে একসাথে দিন, অন্যথায় এ অবাস্তব জগাখিচুড়ি ও হানাহানিপূর্ণ পরিকল্পনা বাদ দিন। তারচে' ভালো, সবাইকে গৃহঋণের আওতায় ছেড়ে দিন। যার প্রয়োজন সে ঋণ নেবে অথবা নেবে না। এতে সবাই একটি সান্ত্বনা পাবে। কোনো মন খারাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না, হবে না কোনো হানাহানি। অপরদিকে এ ঋণের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপীও হবে না। কারণ তারা ঋণ নেবে তাদের ভাতার বিপরীতে যে ভাতাটি সরকারেরই হাতের মুঠোয় ভাতাটিই তাদের ঋণের নিরাপত্তা কো-লেটারাল সিকিউরিটি হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং সরকারের কাছে আমার আবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না করে, তাদের মনে ব্যথা না দিয়ে অবিলম্বে বিনামূল্যের বীর নিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে বীর নিবাস নির্মাণের নকশা অনুসরণ সাপেক্ষে সবার জন্য গৃহঋণের সুব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এতে চিরবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের বেদনার্ত বুকে একটা অপার শান্তি ও সান্ত্বনা বয়ে আনবে।

(এ/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩)