বিরলের বহলা গণহত্যা দিবস আজ
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : ১৩ই ডিসেম্বর। দিনাজপুরের বিরল বহলা গণহত্যা দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে সন্ধ্যায় নামাজরত অবস্থায় বিরলের বহলা গ্রামে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ব্রাশ ফায়ারের মাধ্যমে নির্বিচারে হত্যা করে ৪৪ জন নিরীহ মানুষকে।
বহলা গণহত্যা দিবসটিকে পালনের জন্য মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) বহলা গণহত্যা দিবস উদযাপন কমিটির আয়োজনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে,কবর জিয়ারত, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া খায়ের, মিলাদ মাহফিল,আলোচনা সভা ও শীতবস্ত্র বিতরণ।
১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে থাকে। ১৩ ডিসেম্বর বিরল উপজেলার ভান্ডারা ও রাণীপুকুর ইউনিয়ন থেকে পিছু হটে দিনাজপুর শহরের দিকে যেতে থাকে খানসেনারা। পিছুহটা খানসেনারা আশ্রয় নেয় বহলা গ্রামে।
মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে? পাকবাহিনীর সদস্যরা এমন প্রশ্ন করলে গ্রামবাসী কেউ মুখ খুলেনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পুরো গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। সে গ্রামে খানদের ক্যাম্প স্থাপন করার প্রস্তাবেও গ্রামবাসী রাজি না থাকায় গ্রামবাসীদেরকেসন্ধ্যার মধ্যে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয়া পাকসেনারা। সেই নির্দেশ অমান্য করলে গ্রামবাসীকে নামাজ পড়তে বলে তারা।
এসময় নামাজরত অবস্থায় নিরীহ গ্রামবাসীর উপর পাকহানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলেই জন প্রাণ হারায় ৪৪ জন নিরীহ মানুষ।
এদের হত্যা করার পরে পাকবাহিনী সেখানে অবস্থান করায় নিহততের স্বজনরা রাতে কোনভাবে লাশের কাছে আসতে পারেনি। পার্শ্ববর্তী গ্রামে লুকিয়ে থেকে সারা রাত ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে শহীদের মা, বোন, স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরা। ভোর বেলা পাকবাহিনী বহলা গ্রাম ত্যাগ করে দিনাজপুর শহর মুখে চলে যায়।
সেই স্থানে জমাট রক্ত আর লাশের স্তুপে ভ্যাপসা গন্ধ ধরে লাশ পচতে শুরু করে। অনেক শহীদের লাশ মাংসাশী কুকুর-শেয়াল খেয়ে ফেলে। টানা তিনদিন পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর বিকালে পাশের গ্রামের কয়েকজন এসে পঁচন ধরা লাশগুলিকে
একসাথে একটি গর্তে সমাধি করে ( কবর দেয়)।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নৌ-পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী শহীদের গণকবরে মাটি ভরাট করে ২০০১১ সালে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।
সেইদিন বহলার গ্রামে স্বামীহারা বিধবা বয়সের ভারে নুয়েপড়া কুলসুম বেওয়া জানালেন, মোর স্বামী,বড় ভাইসহ হামার পরিবারের ছয়জন পুরুষ ওমরা মারি ফেলাইছে। মাগরিবের নামাজ শেষ হবার দেইনি। তাদেই গুলি করিছে।
সেদিন ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ ইব্রাহিম খলিল বিচ্ছু স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে জানালেন, তিনি একটি বাড়ির মাটির কোঠায় আশ্রয় নেয়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি।
তিনি বলেন,দেশ স্বাধীনের দু’বছর পর অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রতিটি পরিবারের ২ হাজার করে টাকা দেয়া ছাড়া অন্যকেউ আর খবর রাখেনি অবিভাবক বিহীন পরিবারগুলোর প্রতি। তবে, আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এখন নিয়মিত দেখছেন,শহীদ পরিবারগুলোকে।
বিরল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবুল কাসেম অরু জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের কাছে পিছু হটে দিনাজপুর শহরে পালিয়ে যায় খান সেনারা। ১৩ ডিসেম্বর বহলায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বিরল ছেড়ে যায় পাকসেনারা। তাই ১৪ ডিসেম্বর বিরলমুক্ত হয়।
বহলা গণহত্যা দিবসটিকে পালনের জন্য আজ মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) বহলা গণহত্যা দিবস উদযাপন কমিটির আয়োজনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে,কবর জিয়ারত, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া খায়ের, মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভা।
সজালে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া খায়ের শেষে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বিরল আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক রমা কান্ত রায়,জেলা পরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেন,৭ নং বিজোড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন সহ অন্যরা। আলোচনা সভা শেষে শহীদ পরিবারের সদস্যদের শীতবস্ত্র কম্বল দেয়া হয়।
(এসএএস/এএস/ডিসেম্বর ১৩, ২০২২)