মাদরীপুর মুক্ত দিবস, উচ্ছ্বাসে বিষাদী স্মৃতি
মোঃ নুরুল ইসলাম
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মাদারীপুর অঞ্চলের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পন শক্রসেনা রাজাকার, আলবদরের পরিচালিত লুণ্ঠন, হত্যা ও নানা পৈশাচিক কর্মকার্যের থেকে অবরুদ্ধ মাদারীপুরবাসী হলো মুক্ত, সর্বস্তরের নারী ও পুরষের ছাত্রচাত্রীদের মধ্যে নেমে এলো প্রশান্তি সকলে ফিরে পেল নব প্রানের স্পন্দন। আনন্দে উদ্ধেলিত হয়ে তারা বরণ করে নিল রনাঙ্গনের লড়াকু মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শ্রদ্ধা আর অফুরন্ত ভালবাসা দিয়ে। আল্লাহর দরবারে জানালো অশেষ অশেষ শোকরিয়া। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়, দিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত পর্বে পৌছাবার আবেগঘন মুহূর্ত উচ্ছলতা শিহরন ও জাগরনের মাঝেও নেই অনাবিল আমেজ। মাদারীপুর মুক্ত দিবসের অনুসঙ্গ ছিল আনন্দে বিষাদে রক্তাক্ত আবহে আবৃত। অনেকের মাঝে স্বজন হারানো যন্ত্রনা বিলাপ ও করুন ছায়া, দৃশ্যত চোখে মুখে ঘিরেছিল। ১৪ বছর বয়সী তারুণ্যে চঞ্চল বালক সারোয়ার হোসেন বাচ্চু গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুও সংবাদে সকলে শোকাহত। মাদারীপুর নাজিম উদ্দিন কলেজ গেটে প্রধান সড়ক সংলগ্ন সর্বকনিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকের ভীড় জমে। মসজিদে মসজিদে শহীদ বাচ্চুসহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকলের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা কওে দোয়া অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
৭১ এর ৬ই ডিসেম্বর গভীর রাত মাদারীপুর ফরিদপুর অঞ্চলের সকল মিলিটারি ক্যাম্পে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল রাও ফরমান আলীর বার্তা পৌঁছাল - “বিচ্ছুরা এগিয়ে আসছে, তীব্র আক্রমন, নাজুক অবস্থায় জীবন বাঁচাতে নিরাপদ ঘাটিতে অবস্থান নিতে হবে” মাদারীপুর - এ .আর. হাওলাদর জুট মিল মিলিটিারি ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর এ হামিদ খটক ঐ বার্তা পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন কি করে সেনাসদস্যদের নিয়ে ফরিদপুর ব্রিগেড ক্যাম্পে পৌঁছা যায়। নানা ফন্দি ফিকির অবলম্বনে সন্তর্পনে প্রস্তুতি। গোপনীয় তথ্য ছিদ্রচ্যুত হয়ে গেল, তৎকালিন মাদারীপুর মহকুমার এস.ডি ও জনাব মতিন এ সংবাদটি পেয়েই তার ড্রাইভার জনাব আলাউদ্দিনের সাথে পরামর্শ কি করে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেওয়া যায়। অগত্যা ড্রাইভার আলাউদ্দিন মাদারীপুর থেকে মিলিটারী পালানোর সংবাদটি ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পৌঁছে দিলেন । মাদারীপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিলুর রহমান খান ক্যাম্পে খবর পাঠালেন।
সমাদ্দার ব্রীজে বড় একটা অপারেশনের জন্য অস্ত্রে সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দ্রুত ঐ এলাকায় পজিশন নিতে হবে। খবর পেয়ে চৌহদ্দি আমগ্রাম কলাগাছিয়া সহ অন্যান্য ক্যাম্পে থেকেও মুক্তিযোদ্ধা এসে ঘটকচর ব্রীজ হয়ে আমগ্রাম সমাদ্দার ব্রিজ এলাকায় সকাল থেকে পজিশন নিতে থাকে। ৮ ই ডিসেম্বর দিন গড়িয়ে গভীর রাত্রির শেষ প্রহরে রাস্তার পূর্বদিক থেকে মৃদু আলো থেমে থেমে ভেসে আসছে গাড়ী বহর এগিয়ে আসছে সমাদ্দার ব্রিজের কাছাকাছি। সেনাসদস্যরা পায়ে হেটে এগুতে থাকে গাড়ীর আড়ালে আড়ালে, মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই ব্রিজে মাইন পুতে রেখেছিল। ওয়ারলেস সেট বহনকারী হালকা জীপ গাড়িটি ব্রিজ পার হয়ে গেল, পিছনে আসা একটি ভারী গাড়ী ব্রিজে উঠা মাত্র মাইন বিস্ফোরণে উল্টে খালে পড়ে যায়। কতক সেনা পার হয়ে ওপারে এবং কতক এপাওে দ্রুত গতিতে তাদের পূর্ব তৈরি ব্যাংকারে ঢুকে পজিশন নিয়েই গুলি ছুড়তে থাকে হানাদার বাহিনী মাত্র ২০০ হতে ৩০০ গজের দূরত্বে আর মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তার পাশ ঘেষে পজিশন নিয়ে গুলি বর্ষন শুরু করে। সারারাত চলতে থাকে সম্মুখ সমরে গোলাগুলি, রাত গড়িয় ৯ ডিসেম্বর দিনের আলোতে উভয় পক্ষের গুলিবর্ষন। দিন পার হয়ে রাত নেমে আসে একটানা গোলাগুলি এরই মধ্যে শক্রদের রসদ ফুরিয়ে যায়। ব্যাংকারে অবস্থানরত সেনাদের খাদ্যের অভাব পানির অভাব তীব্র হয়ে উঠায় আত্মসমর্পনের সংকেত দিয়ে সামান্য বিরতিতে সৈন্যরা তাদের গাড়ী থেকে খাদ্য নামিয়ে নেয় আর খাল থেকেও পানি নেয়। তাল বাহানার আত্মসমর্পনে ছিল এক ধরনের ধোকোবাজি এতে মুক্তিযোদ্ধা সতর্ক থেকে যার যার পজিশন তীক্ষ্ণ কৌশলী হয়ে উঠে। শক্র সেনাদের সুবিধাজনক উচ্চ স্থানের পজিশন থেকে পূনরায় গুলিবর্ষন শুরু হলো। যুদ্ধকালীন কমান্ডার মেজর খলিলুর রহমান চরম আক্রমনে তাদের রনকৌশল পাল্টায়ে শক্রসেনাদের ব্যাংকারে গ্রেনেড হামলা চালাতে থাকে। এ গ্রেনড হামলায় অদম্য মনোবলে সর্বকনিষ্ট বালক সারোয়ার হোসেন বাচ্চু হানাদারদের মারতে হবে এবং একের পর এক গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। নিজের জীবনের প্রতি লক্ষ্য না করেই মৃত্যুঞ্জয়ী বালক লড়ে যাচ্ছিল। কোন এক মুহুর্তে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি এসে লাগল বাচ্চুর মাথায়, ঢলে পড়ে গেল –মাটির কোলে, মৃত্যুযন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে আর ডাকছে অস্পষ্টস্বরে, গুলির শো শো শব্দে বাচ্চুর ডাক কেউ শোনতে পেল না। কারো স্পর্শ না পেয়েই তার জীবন প্রদীপ নেভে গেল। ডাক শুনে যদি কে কেউ না আসে - একলা চল একলা চল রে। কবির অমর বাণী কে রেখে, বাচ্চুর আত্ম চলে গেল না ফেরার দেশে। নিথর দেহ পড়ে রইল মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের সামনে মাটির বুকে। গোলাগুলির মাঝে এক পর্যায়ে বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো মাদারীপুরে। মুক্তিযোদ্ধাদের চরম আক্রমনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পর্যুদস্ত তাদের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়, জীবন মরণ ক্ষণে নিরুপায়। এ হেন পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচাতে আত্মসমর্পন ভাবনা - শক্রসেনা কমান্ডার মেজর খটক স্বীয় সাদা রুমাল উড়িযে ব্যাংকার থেকে বেরিয়ে এলেন। মাথার ক্যাপ খুলে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো- সারেন্ডারে, সারেন্ডারে। মেজর খলিল খান কে ভেজদো, মেজর খলিল খান সহ মুক্তিযোদ্ধারা হতভম্ভ , কি সত্যিই সারেন্ডারে ? বার বার আহ্বানে সাড়া দিয়ে খলিল খান এগিয়ে এলেন - আমি মেজর খলিল খান । মেজর খটক তার ক্যাপ খলিল খানের মাথায় পরিয়ে দিয়ে করমদন করলেন। শক্রবানিহী ও মুক্তিবাহিনীর হাত মেলানো পর্ব চারিদিক নিরবতা শ্বাসরুদ্ধকর আবহে সকলে চেয়ে আছে।
মেজর খটক তার মাজার বেল্ট ও সাদা বাটের পিস্তল খলিল খাঁনের হাতে দিয়ে চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে উচ্চুসিত মেলেটারীদের পরাজয় বার্তা বয়ে গেল। মাদারীপুর শহর থেকে গ্রাম- গঞ্জে। এ আনন্দের মাঝেও যেন বিষাদের সুর থেমে থেমে অনুরণিত মাদারীপুর শহর জুড়ে ।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা।