এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ দিনের কথা
দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সশস্ত্র সাজে সজ্জিত হয়ে নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নারী, পুরুষ, শিশু কেউই তাদের আক্রমন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নির্বিচারে সবার ওপর গুলি চলছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রেডিওতে দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও, নারী নির্যাতন ও লুটতরাজের খবর সর্বাক্ষনিক প্রচার হচ্ছে। এ ঘৃণ্যতম আক্রমনের দাঁতভাঙা জবাব দিতে এবং দেশকে স্বাধীণ করতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্কুল,কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় অঘোষিত বন্ধ। টগবগে ছেলেরা যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহনের জন্য দলে দলে ভারতে যাচ্ছে। আবার ট্রেনিং দেশে দেশে প্রবেশ করে বিচ্ছিন্নভাবে শক্রর মোকাবেলা করছে। এই ট্রেনিং প্রাপ্তদের কাছেও গোপনে গোপনে দেশের দুরন্ত ছেলেরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, লুন্ঠন ও মা-বোন সম্ভ্রম হরণের চিত্র বিবেকবান মানুষকে বিচলিত করত। তাই প্রতিশোধ। এ প্রতিশোধ নেয়ার প্রত্যয় থেকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদুদ্ধ হয়েছিলাম।
যুদ্ধক্ষেত্রে আমিও যে মৃত্যুর সম্মখীন হতে পারি এমন ধারণা যা যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলদ্ধি করার যথেষ্ট জ্ঞান তখনও হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি এবং মাঝেমধ্যেই হানাদার বাহিনী ওপর অতর্কিত আক্রমন,তাদের অদৃশ্য শক্তি প্রদর্শন সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করত এবং মুক্তিযুদ্ধে যেতে বিপুল উৎসাহ যোগাত।
সবেমাত্র ৭ম শ্রেণী পেরিয়ে ৮ম শ্রেণীতে প্রবেশ করেছি। বয়স ১৭ বছর। বয়স ও শারীরিক গঠনের কারণে কেউই আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার উৎসাহ দিতেন না। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। যুদ্ধে যেতেই হবে। যুদ্ধের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে অস্ত্রের টেনিং নেয়া অপরিহার্য। পাশর্^বর্তী বন্ধুরাষ্ট্রে ভারত ট্রেনিং প্রদানে সর্বাত্মক সহযোগিতার হতে বাড়িয়েছে।
নৌকা ভাড়া করে দলে দলে ভারতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি ও দলে অন্তর্ভুক্তির জন্য গোপনে তালিকা করা হচ্ছে। কোনোক্রমে তালিকাভুৃক্ত হতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি একই কথা- আমার যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি। বয়সের ঝুঁকি মনে করে কেউই আমাকে সঙ্গে নিতে চায়নি। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জাতির এই ক্রান্তিাকালে আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করবো।
লুকিয়ে লুকিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকলাম। কখন কোন নৌকা রওনা হয়। ২৩ জুলাই’৭১ আমাদের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাড. জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যারের সাথে আমরা ২২ জন নৌকায় রওনা হলাম মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সপ্ন বাস্তবায়নে ভারতের উদ্দেশ্যে। মধ্যে রাতে দেখে শুনে নৌকা চালিয়ে এভাবে সুজনগর উপজেলার সাত বাড়িয়া নামক স্থানের কাছে আমাদেরকে নামিয়ে দেয়া হলো। হেঁটে হেঁটে সুজানগরের এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে উঠলাম আমাদের পরিকল্পনা ছিল। সুজানগরের কাছের নদী পার হয়ে কুষ্টিয়া জেলার প্রত্যন্ত এলাকা হয়ে ভারতে যাব।
জানতে পারলাম দিনে নদী পাড় হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ দিনের বেলা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা স্পিড র্বোড নিয়ে নদী পথ টহল দেয়। সন্দেহ হলে গুলি করে নৌকা নদীতে ডুবিয়ে দিবে অথবা ধরে নিয়ে নির্র্যাতন ও নৃশংস ভাবে হত্যা করবে। সারা দিন সুজানগরে থাকলাম। রাতের খাবার খেয়ে রাতে ৯টার দিকে নদীর পাড় হওয়ার জন্য ভাড়া করা দুই ওয়ালা নৌকায় উঠলাম। রাত একটার দিকে কুষ্টিয়া জেলার একটি গ্রামে পৌছালাম। এক বাড়িতে অতিথি হলাম। বাড়ির মালিকত কাঠাল গাছ থেকে কাঠাল পেড়ে প্রথমে মুরি ও কাঠাল খাওয়ালেন। ঐ এলাকার লোকজন কাকাও জ্যাঠাকে বড় আব্বা ছোট আব্বা বলে ডাকেন। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে জানলাম। ওখানে অবস্থান করাও অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ন। গ্রামে পাকিস্তানি দালাল পিচ কিমিটির লোক আছে। গ্রাম থেকে অল্প কিছু দূরেই পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও রাজাকার ক্যাম্প আছে।
পাকিস্তানি দালালরা টের পেলে তারা গিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ক্যাম্পে অথবা রাজাকাদের ক্যাম্পে সংবাদ দিবে। হানাদারেরা সংবাদ পেলে এসে ধরবে। নির্যাতন ও নৃশংস ভাবে হত্যা করবে। আশ্রয় দাতার বাড়িঘর লুটরাজ করাবে,অগ্রিন সংযোগ করে পুড়িয়ে দিবে। বাড়ির মালিক ও অন্যান্যদের কে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করতে পারে । তিনি তাড়াওহুরা করে ডাল ভাত রান্না করে আমাদের খাবার ব্যবস্থা করলেন। আমরা তাড়াহুরা করে ডাল ভাত খেয়ে রাত ৪ টার দিকে পায়ে হেঁটে ভারতের উদ্দেশ্য রওনা হলাম। রাত টি ছিল মেঘাচ্ছন্ন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। লাল কাদা মাটির রাস্তা। বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। এম,পি,এ স্যারে হেঁটে চলা কষ্ট হচ্ছেন। সবাই ওনাকে ধরে ধরে হাটিয়ে নিয়ে গেলেন। ভোরের দিকে বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করলাম। ভারতের নদীয়া জেলার জলঙ্গী সীমান্ত পৌঁছালাম। পাশের্^ই ছিল ভারতীয় সিমান্ত বাহিনী বি,এস,এফ ক্যাম্প।
ওনারা আমাদের কে সহযোগিতা করলেন। আমরা স্বস্তির নিশ^াস ফেলালাম। যার যার মত প্রাত: ক্রিয়াদি সেরে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলাম। সকালের খাবার খেলাম। মানি একচেঞ্জ দালালদের কাছ থেকে টাকা বদলিয়ে নিলাম। এম.পি.এ স্যার আমাদের কে কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌছানোর জন্য বাস ভাড়া করলেন। মালদই শহরে গিয়ে আমাদের যাত্রা বিরতি করা হলো। এম.পি.এ স্যার কাঠাল আর মুরি কিনে আমাদের খাওয়ালেন। তারপর আমাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ভর্তি ও প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌছানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি অস্থায়ী সরকারের অফিস কালিকাতার উদ্দেশ্য যাত্রা করলেন। মালদগ থেকে বাস ছাড়লো। রাত ৯ টার দিকে আমরা গিয়ে পৌছাঁলাম কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পে কর্তৃপক্ষ আমাদের থাকাও খাবার ব্যবস্থা করলেন। পরদিন মুক্তিযোদ্ধা রিত্রুটমেন্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের ফলিং করালেন। আমার বয়সের স্বল্পতার কারণে ভর্তি করতে চাইলেন না। ভর্তি কর্তৃপক্ষের একটি দল আমার একটি সাক্ষাৎকার নিলেন।
আমার দেশ প্রেম,সাহসী মোনভাব ও অন্যান্য অঙ্গিকারের কথা শুনে ভর্তি করলেন। প্রাথমিক ট্রেনিং ক্যাম্পে শুধু আমাদের ফলইং করিয়ে জাতীয় সংগীত খাওয়ানো হতো আর পিটি প্যারেড করানো হত। কদিন কামার পাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকার পর আমাকে ট্রান্সফার করলেন মালঞ্চ ক্যাম্পে। এক দিন পর ট্রান্সফার করলেন কুড়মাইল ক্যাম্পে। একদিন পর কুড় মাইল থেকে আমাকে আনা হলো পতিরাম ক্যাম্পে। চার দিন পর পতিরাম ক্যাম্পে থেকে এক যোগে ইন্ডিয়ান আর্মি লরিতে আমাদের ২০/২২ জন কে নিয়ে আসা হলো ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানি ঘাটা ট্রেনিং সেন্টারটি ছিল পাহাড়ের মধ্যে বনাঞ্চল। ক্যাম্পে টি ছিল কার্শিয়ান পাহাড় হইতে নেমে আসা একটি ক্যানেলের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত। ক্যাম্পে তাবুর মধ্যে আমাদের থাকার সিট করে দিল। আমি রবীন্দ্র নাথ বাগচী মো: নজরুল ইসলাম আর রতন কুমার দাস এক তাবুর মধ্যে সিট নিলাম। আমাদের ব্যবহারের জন্য প্রত্যেককে একটা মগ,একটা প্লেট ও একটা গেঞ্জি দিল। প্রথম দিনেই প্রশিক্ষণের শুরুতে ক্যাম্পে নিয়ম কানুন ও চারি পাশের কথা বললেন। প্রধান প্রশিক্ষণ শিখ সেনা ডি.এস.ভিলন বললেন- ক্যাম্পের তিন দিকে বিভিন্ন হিংস্র প্রাণী ও বন মানুষ আছে। শুধু মানুষ আর মানুষ।
বাংলাদেশে থেকে দলে দলে হিন্দু শরণাথীরা এখানে এসে জনসংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তার দু’পাশে ভাবুর মধ্যে গাদাগাদি হয়ে শরণাথীদের বসবাস। সে যে কী করুন দৃশ্য তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ,শুধু অণুভব করা যায়। আমাদের নিয়ে যাওয়া হল মরণটিপা/ময়নাটিপা ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধে টেনিং গ্রহণের যোগ্যতা নিধারনে এটি প্রাথমিক যাচাই বাছাইয়ের স্থান। টিলার উষ্টতা এত বেশি যে একবার সমতলে নামলে উপরে ওঠার সাহস হারিয়ে যায়। যাচাই-বাছাইয়ের সময় আবার এই নিপতি। আমাকে নিয়ে টানাটানি। এত অল্প বয়স এবং হালকা-পাতলা শরীর নিয়ে যুদ্ধে করার সক্ষমতা নেই মর্মে বিচারকদের ধারণা। বকুম হল, ভারতের দাজিলিং জেলার শিলিগুড়ির পানিঘাটা ট্রেনিং যাওয়ার জন্য।
কখনে স্থলপথে বাস টাক আবার কখন ও জলপথে লঞ্চ-স্টিমারে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে উপস্থিত হলাম পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণের ক্যাম্পেটি ছিল ৭ নম্বার স্কেটরের আওতাধীন। ক্যাম্পে সারিবদ্ধভাবে তাঁবু নিমার্ণ করা হয়েছে। এক তাঁবুর মধ্যে মাটিতে খেজুরের পাটি, তার ওপর কখনের বিছানা। কয়েকটি কোম্পানীতে বিভক্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আলফ্যাবিটিক্যাল অর্ডারে কোম্পানির (আর্মিদের প্লাটুন, কোম্পানি থাকে) নামকরণ করা হয়েছে।
যেমন-এ কোম্পানি কে আলফা,বি কোম্পানিকে বেটা ,সি কোম্পানিকে টালি ইত্যাদি। আমি অন্তভুক্ত হলাম বা বেটা কোম্পানি বরাদ্দ পেয়ে লাইনে দাঁলাম। প্রত্যেকে দেয়া হল দুটি তরঙ্গপুর থেকে আমাদের নামে নামে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইস্যু করা হলো। ১০ জনের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ করা হলো। আমাদের সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের এম.এ.মানান আমাদের গ্রুপ লিডার নিযুক্ত হলেন। ডেপুটি লিডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর উপজেলার জমিরতা গ্রামের রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমার নামে বৃটিশ থ্রি-নট-থি ১টি রাইফেল ও এক ম্যাগজিন গুলি,হেলমেট ইস্যু করলেন। আর সব গোলা বারুদ, মাইন, ২টা মর্টারও অন্যান্য এস প্রোসিভ সরবরাহ করলেন আমাদের কমান্ডার স্যার এম.এ মান্নান সাহেবের কাছে। আমাদের মাসিক ৬০ টাকা হারে রেশনিং এ্যালাউন্স ও ৫০ টাকা হারে পকেট মানি দিলেন। সনাতন ধমানুসারে যুদ্ধে জয়ের জন্য দুর্গাস্তর করতে হয়। তাই তরঙ্গপুর বাজার থেকে আমি একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রস্থ ক্রয় করলাম। যুদ্ধে যে কোন সময় মারা যেতে পারি। আমি মারা গেলে রনাঙ্গনের অন্যান্য সহ যোদ্ধারা যাতে জাতীয় পতাকা দিয়ে মোড়ায়ে আমার মৃত দেহটা জলে ভাসিয়ে দিতে পারেন সে জন্য একটি বাংলাদেশের মানচিত্র ঘচিত জাতীয় পতাকা ক্রয় করলাম।
রণাঙ্গনের উজ্জীবিত হওয়ার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর অনুষ্ঠান ও সংবাদাদি শোনার জন্য একটি ৪ ব্যান্ডে রেডিও ক্রয় করলাম। ৪ সেপ্টম্বর’৭১ তরঙ্গপুর থেকে আমরা রওনা হলাম। কিছু দূরে বাসে এসে একটা রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসন ষ্টেশণে এসে আমাদেরকে ট্রেন বদলাতে হলো। শিলিগুড়ি ষ্টেশনে ৩/৪ ঘন্টা অবস্থানের পর আসাম গামী ট্রেন এলো। আসাম গামী ট্রেনে আসাম জেলার ধুবরী ষ্টেশনে নামলাম। তার পর বাসে ৫ সেপ্টেম্বর’৭১মানিকার চর পৌঁছালাম। মানিকার চর পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে গেল।ঐ রাত মানিকার চর একাটি বোডিং থাকলাম। পরদিন সকালে নদীর পার হয়ে এলাম রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম (মহকুমার বর্তমানের জেলা) রৌমারী ক্যাম্পে আমাদের স্নান খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হলো। সিরাজগঞ্জে যমুনার চড়ে পৌছানোর চুক্তিতে কমান্ডর স্যার একটি দুইওয়ালা নৌকা ভাড়া করলেন। ৬ সেপ্টেম্বর’৭১ রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯.০০ টা দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। নৌকা বাহাদূরবাদ ঘাটের সম্মূখ দিয়ে আসতে হয়। রৌমারী ক্যাম্পে থেকে আমার জানতে পেরে ছিলাম বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকার অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা। ঘাটের অদূরে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার ক্যাম্পে আছে। তারা ভয়ানক খারাপ। তারা স্পিড বোর্ড দিয়ে রাতে নদী টহল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিকব অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে।
আমাদের কমান্ডার স্যার নির্দেশ দিলেন। আমরা সবাই ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকবো। পাকিস্তানি হায়েনারা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে শহীদ হবো। কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না । রাত ২.০০ টার দিকে আমরা বাহাদূরবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ঘাট থেকে হানাদারদের সার্চ লাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকার উপর পড়ছিল। ভগবানের কৃপায় ওরা আর স্পীড বোর্ড নিয়ে ধরতে এলো না। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বাহাদূরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের চিড়াও গুড় ছিল। ভোরে এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে দিল। আমরা সবাই খেতের মাঠে প্রাতঃক্রিয়া সারলাম।আজ রাতে এ গ্রামে কাল রাতে ও গ্রামে শেল্টাল থাকাল। সকালে অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম। অস্ত্র পরিস্কার করে তেল দিতাম। তখন গুট কয়েক স্বাধীনতা বিরোধী ছাড়া অধিকাংশ মানুষ ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে। তবুও অনেকেই পাকিস্তানি হানাদারও রাজাকারদের ভয়ে আমাদের থাকার জায়গা ও খাবার দিতে চাইতেন না। অধিকাংশ গ্রামের ছিল। পাকিস্তানের দালাল ও রাজাকার ক্যাম্পে খোঁজে দিয়ে নিয়ে এসে বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিবে লুটতরাজ করাবে, বাড়ির মালিককে ধরে নির্যাতন করবে। গ্রামে হত্যা ,গণ হত্যা নারী নির্যাতনের প্রভৃতি মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড চালাতে পারে আবার কিছু বাড়ির মালিক ছিল নির্ভাক। তারা আশ্রয় ও খাবার দিতেন। আমরা কখনও কখনও স্কুলে আশ্রয় নিয়ে থাকতাম।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গোপনে আমাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করতেন। আমাদের সাথে সব সময় চিড়া গুড় থাকতো। কোন দিন খাবার পেতে সমস্যা হলে আমরা চিড়াগুড় খেয়ে থাকতাম । এই ভাবে কয়েক দিন বয়ড়া মাসুম ও অন্যান্য গ্রামে থাকতাম। মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহনে করতে ইচ্ছুক কিছু যুবক সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ করিয়ে আমাদের সাথে নিলাম। তারা রেকী ও অন্যান্য কাজে আমাদের কে সহযোগীতা করতো। আমরা কোন থানা ,পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্পে রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন করা পূর্বে রেকী করতাম। আমি ছোট হওয়ার কারণে অধিকাংশ রেকীতে অন্যানের সাতে আমি থাকতাম। আমরা ১. বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ ২. কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশণ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস ৩. বেলকুচি থানার কল্যাণপুর যুদ্ধ ও ৪ শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক ভয়াবহ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। সকল যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার ও বাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে করে বিজয়ী হয়েছি।
১ ডিসেম্বর কোন সংখ্যত ব্যতিরেকে শাহজাদপুর থানা শক্র মুক্তি হয়। দীর্ঘ সংগ্রাম ও নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পর আসে ১৬ ডিসেম্বর’১৯৭১। সবার বাধভাঙ্গা আনন্দ। তবে এ আনন্দ অর্জিত হয় লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আর এর সঙ্গেই সমাপ্ত ঘটে মহান মুক্তিযুদ্ধের। পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি স্বাধীন-সার্বভেীম দেশ, লাল-সবুজে বাংলাদেশ। বিজয়ী-পরবতী তে মুক্তি যোদ্ধাদের নিয়ে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। রবীন্দ্র নাথ বাগচী নিয়ন্দ্রনে জমা দিয়ে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্য। আমরা দুই সহোদর একই গ্রুপের অধিবাসী ও সহযোদ্ধা আব্দুল সামাদ,আব্দুল কাসেম, আজিজুর ও মামা হক একসাথে বাড়ি পৌছে গেলাম। শুধু বাড়ির লোকই নয় গ্রামের অনেক লোকই আমাকে দেখতে এলো আদর করল জার প্রশংসা করল আমার কিশোর বয়সের সাহসিকা ও বীরত্বের জীবনের শেষলগ্রে উপনীত হয়ে স্মরণ করছি সেই সহযোদ্ধাদের। তাদের মধ্যে জানা-অজানা অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর ডাকে সাড়া দিয়ে সমস্ত জাতির ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। সৃষ্টি মেঘ পাকিস্তানে পদলেহী ব্যক্তি ছাড়া দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসর প্রাপ্ত ব্যাংকার।