রোয়াইলবাড়ী দূর্গসহ কেন্দুয়ার পাঁচটি দর্শনীয় স্থানে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা
সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া : ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ি পুরাকৃতি (দূর্গ) সহ কেন্দুয়া উপজেলার ৫টি দর্শনীয় স্থানে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। স্থানীয় ও সরকারের সঠিক পৃষ্টপোষকতার অভাবে এসব দর্শনীয় স্থানগুলো অযতœ অবহেলায় পরে আছে। পর্যটনের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ৫টি দর্শনীয় স্থান দৃষ্টিনন্দন করার কাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে। যে কারণে দীর্ঘদিনেও আলোর মুখ দেখছেনা এসব দর্শনীয় স্থানগুলো।
পাঁচটি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ী আমতলা ইউনিয়নের অন্তর্গত ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ী পুরাকৃতি (দূর্গ), একই ইউনিয়নের নন্দিত কথা সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের কলম জাদুকর হুমায়ুন আহমেদের জন্মস্থান কুতুবপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ। এ দুটি স্থানে প্রতিদিন দর্শনার্থীদের আনাগুনা থাকলেও পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা দেয়ার কাজ এখনও থেমে আছে। সরকারি ভাবে রোয়াইলবাড়ী দূর্গ এলাকায় কিছু উন্নয়ন কর্মকান্ড হলেও পরিপূর্ণ একটি দর্শনীয় স্থানের জন্য পর্যটনের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার এখনও তেমন ভাবে এগিয়ে আসেননি। দূর্গটি বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় পরে আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এসব নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য মাঝে মধ্যে খনন কাজ শুরু হলেও মাঝ পথে আবার থেমে যায়। অযত্ন অবহেলা ও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ঐতিহাসিক এই নিদর্শন রোয়াইলবাড়ী দূর্গ একরকম হুমকির মধ্যেই আছে।
এলাকাবাসীর দাবি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ি দূর্গ এলাকা থেকে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব প্রাপ্তির ও সম্ভাবনা রয়েছে। কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিম দিকে অবস্থিত তৎকালিন মোগলী আমলের প্রশাসনিক ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ি দূর্গ। কালের আবর্তে এই রোয়াইলবাড়ি দূর্গ হারিয়ে যায় মাটির নিচে। প্রায় দুই যুগ আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন কাজ পরিচালনা করে দূর্গটির সন্ধান পায়। সে সময় মাটির ডিবি খনন করে মোগলী আমলের কারুকার্য সম্বলিত ইট দিয়ে গড়া একটি ১২ দুয়ারী মসজিদ এবং এর আশেপাশে প্রাসাদের চিহ্ন ও একটি সুরঙ্গ পথের সন্ধান পায়। সুরঙ্গের পাশেই একটি বটগাছের নিচে রয়েছে নিয়ামত বিবির মাজার এবং ১২ হাত লম্বা ডেঙ্গু মালের কবরস্থান। কিন্তু অজানা কারণে খনন কাজ শুরু হলেও প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর কাজ বন্ধ করে দেয়। নেত্রকোণা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৮৭ সনে ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষায় ৪৬ একর ভ‚মি পুরাকৃতি এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। সে সময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শুধু একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়ে এলাকাটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে। তবে নির্মাণ করা হয়নি কোন প্রাচীর। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাথরের ও কাঁচের পিলার।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত কয়েকবছর আগে আরো বেশ কিছু খনন কাজ করে ১২ দুয়ারী মসজিদের দক্ষিনে আরো কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন খুজে পায়। খুজে পায় দূর্গের ফটকের সন্ধান। খনন করে সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয় বিভিন্ন কারুকার্য সম্বলিত ইট পাথর। অস্থায়ী ভাবে প্রদর্শনী স্থাপন করা হলেও খনন কাজ দেখতে পরিদর্শনে আশা তৎকালিন প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের মহা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব আলতাব হোসেন) এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে রোয়াইলবাড়ি দূর্গ এলাকাটি পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা দেয়ার আশ্বাস দিলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ি দুর্গ এলাকা দেখতে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা আসেন। কিন্তু সম্ভাবনাময় এই পর্যটন এলাকাটিতে নেত্রকোণা জেলা পরিষদের উদ্যোগে পাকা করে দুটি ছাতা আকৃতির বিশ্রামাগার নির্মান করলেও এর আধুনিকায়নে আর কিছুই হয়নি। এখানে নেই কোন হোটেল মুটেল। নেই গণসৌচাগার। পর্যটকদের থাকা খাওয়ার কোন ব্যবস্থাই নেই। ফলে পর্যটকদের এখানে এসে পড়তে হয় বিরম্বনায়। প্রাচীন রোয়াইলবাড়ি দূর্গের স্থাপনা হিসেবে ছাঁদ বিহীন কিছু ইমারত রয়েছে। বেথাই নদীর তীরে অবস্থিত এই দূর্গটি পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষন করা হলে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা হতে পারে।
কেন্দুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লোক সাহিত্যিক মোঃ নূরুল ইসলাম দাবী করে বলেন, ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ি দূর্গ সহ ৫টি দর্শনীয় স্থানকে পর্যটন এলাকা ঘোষনা এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন হবে গ্রাম উন্নয়ন বাড়বে সরকারের রাজস্ব। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র নছরত শাহ এ অঞ্চলে বসবাসের সময় দূর্গটি সম্প্রসারন করেছিলেন। এমনটিই স্থানীয়দের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। পরবর্তীতে ঈশাখাঁ ও তার পরবর্তী শাসকদের আমলেও দূর্গে সম্প্রসারনের কিছু কাজ হয় বলে তিনি মনে করেন। ৪৬ একর জমির উপর অবস্থিত পুরো দূর্গটি পূর্ব পশ্চিম দিকে লম্বা ও প্রাচীর দ্বারা বিভক্ত। দূর্গের প্রাচীর নির্মানে ব্যবহার করা হয়েছে ইট। এছাড়া দূর্গের পাশেই রয়েছে। একটি বিশাল আকৃতির পুকুর। গত বছর পুকুরটি খনন করে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। রয়েছে দুটি মাটির ডিবি। একটি কবরস্থান, নিয়ামত বিবির মাজার সহ বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। খনন কাজ পরিচালনা কালে এখানে প্রাচীন ইটের ভগ্নাংশ মৃৎপাত্র, মুর্তি ও মূল্যবান কিছু আবিস্কৃতি পুরাকৃতি রয়েছে।
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাবেরী জালাল ১৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে গ্রামীন উন্নয়নে পর্যটন শীর্ষক কর্মশালায় সভাপতির বক্তব্যে বলেন, রোয়াইলবাড়ি দূর্গ এলাকায় কিছু উন্নয়ন কাজ হয়েছে, আরো হবে। তবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে দূর্গ এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে খুব দ্রুতই পাঠানো হবে। রোয়াইলবাড়ি আমতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান আকন্দ বলেন, রোয়াইলবাড়ি পুরাকৃতি ও কুতুবপুর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এলাকাটি পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা করা হলে সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব আদায় হবে।
কেন্দুয়া উপজেলার চিরাং ইউনিয়নের সাজিউড়া গ্রামে রয়েছে অবিভক্ত ভারতের অর্থমন্ত্রনী নলিনী রঞ্জন সরকারের পৈত্রিক বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ। ওই বাড়িটি সহ গ্রামের বাউলকবি দীন শরৎ, নাট্যজন সুশিল বিশ্বাস, প্রখ্যাত চিত্রকর শসি মোহন হেষ, গীতিকবি সুমঙ্গল বিশ্বাসের কৃতী দেখতে বিভিন্ন জন আসেন। কিন্তু নলিনী রঞ্জন সরকার সহ দীন শরতের পৈত্রিক ভিটে বাড়িতে পর্যটন উপযোগী গড়ে তুলা হলে এখানেও সরকারের রাজস্ব আয় হবে এবং গ্রামের হবে উন্নয়ন। এর ৩ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত কৈজানি নদীর তীরে তাম্বুলী পাড়া ন্যাচারাল পার্ক। এখানেও প্রতিদিন শতশত মানুষের আনাগুনা হয় মুক্ত বাতাস এবং সুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করার। নেত্রকোণা- ৩ আসনের এমপি ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল আনুষ্ঠানিক ভাবে গত বছর উদ্বোধনের পর তৃষিতপুর সামাজিক ও মানবিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে ৫শ কৃষ্ণচ‚ড়া গাছের চারা রোপন কাজের উদ্বোধন করেছিলেন নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক কাজি আবদুর রহমান। তিনি এটিকে রাঙ্গাপথ নামে ঘোষনা দিয়েছিলেন। এটিকে এখনও সরকারে পুরোপুরি দৃষ্টিতে নেয়া হয়নি। এর ৮ কিলোমিটার উত্তরে সাঁইডুলি নদীর তীরে গোগবাজার এলাকায় পর্যটকরা প্রতিদিন আসলেও এখানেও তেমন কোন স্থাপনা গড়ে তুলা হচ্ছেনা। তিনটি নদীর মোহনায় এখানে প্রতিবছর অষ্টমী¯œান উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়।
অপর দিকে দলপা ইউনিয়নের জল্লী গ্রামে অবসরপ্রাপ্ত জজ লতিফ আহম্মেদ খানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠেছে বিশাল নিঝুম পার্ক। এই পার্কে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আনাগুলো করলেও সরকারের তেমন নজর নেই এখানেও। এলাকাবাসী রোয়াইলবাড়ী পুরাকৃতি সহ ৫টি দর্শনীয় স্থানকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনার দাবী সময়ের দাবি বলে মনে করছেন। আর এগুলোর উন্নয়ন হলেই হবে গ্রামের উন্নয়ন এবং মানুষের মানবিক উন্নয়ন।
(এসবি/এএস/নভেম্বর ১৯, ২০২২)