গণহত্যায় স্বামী ও স্বজন হারানো এক মায়ের বয়ান
দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
২৫ মার্চ ৯৭১ মধ্য রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার ঘুমন্ত, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নজির বিহীন গণহত্যা যা এখনো বিশ্বের কোটি মানুষের বিবেককে পাড়া দেয়। ৯ মাস ধরে চলা নির্মম হত্যা যজ্ঞের একটি পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ইউনিয়নের ডেমরা ও সাঁথিয়া থানার রূপসী (বোউসগাড়ী) গ্রামের গণ হত্যা। ডেমরা গ্রামের বিয়ে হয়েছিল রতন কান্দি গ্রামের ঠাকুর বাড়ি মেয়ে স্নেহলতা সান্যাল। স্নেহলতা সান্যাল স্বামীর নাম প্রবোধ কুমার মজুমদার(মোনা মজুমদার)। ডেমরা গনহত্যায় প্রবোধ কুমার মজুমদার (মোনা মজুমদার) স্নেহলতা সান্যালের ভগ্নিপতি উল্লাপাড়া থানার বামন গ্রামের লালু চক্রবর্তী।
ডেমরা জমিদার বাড়ির গোড়া রায় রূপসী (বাউসগাড়ী) গ্রামের জমিদার বাড়ির বলরাম রায়, রাম জগন্নাথ রায়, পাবনার এডরুক কোম্পানীর লেবার ইনর্চাজ দিলীপ কুমার রায় সহ সাত শতাধিক হিন্দু মুসলমান, নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর শহীদ হন। গণহত্যাটি ঘটিয়ে ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ মে শক্রবার ১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮। স্নেহলতা সান্যাল ছিলেন আমার পিতৃদেব দিজেন্দ্র নাথ সান্যালের পিসিমা।পিতৃদেবের নির্দেশে ২১ মে’৭১ আমি ডেমড়া গিয়ে আমার পিসি ঠাম্মি স্নেহলতা মজুমদারকে রতন কান্দি নিয়ে এসে ছিলাম। আমাদের রতন কান্দি বাড়িতেই প্রবোধ কুমার মজুমদার ও লালু মজুমদারের শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া করা হয়। স্নেহলতা -মোনা মজুমদার দম্পত্তি ছিলেন নিসত্তান। স্বামী হারানো স্নেহলতা শোকে সব সময় কান্না কাটি করতেন। আমরা সবাই ইতি বাচক কথা বলে শান্তনা দিতাম।একদিন তাঁর কাছে গণ হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘আমাদের ডেমড়া গ্রাম টিতে আমরা হিন্দু-মসলমান মিলে মিশে বসবাস করি। আমাদের গ্রামের মুসলমানের খুব ভাল। ১৯৭০ সালের ৭ ডিস্বেমর সাধারণ নির্বাচনে সামান্য কিছু মুগল মান ছাড়া সবাই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে ছিলাম। রেডিও শুনে ও ঢাকা ও অন্যান্য স্থান থেকে আসা লোকের মুখে আমরা দেশের ভয়াবহতার কথা জানতে পারতাম। একদিন স্থানীয় নেতৃস্থানীয় মুসলমানেরা আমাদের হিন্দু প্রধানদের ডেকে বললেন-দেশের যাই হোক, আপনারা কোন ভয় পাবেন না, আমরা আপনাদের কোন ক্ষতি করবোনা এবং অন্য কেহ যাতে আপনাদের কোন ক্ষতি করবো না এবং অন্য কেহ যাতে আপনাদের ক্ষতি না করতে পারে সে জন্য সব ব্যবস্থা করবো।’
আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মুসলমান খুব ভাল। তাঁরা দল বেধে বেধে রাতে আমাদের বাড়িঘর পাহাড়া দিতেন। আমাদের গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিলনা। যে কারণে নিরাপদ গ্রাম হিসেবে বিবেজনা করে পাবনা শহর, বেড়া, সাঁথিয়া, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, কুচিয়া মোড়া নগর বাড়ি, প্রভৃতি এলাকার ধনাত্য হিন্দু ব্যবসায়ীরা টাকা-পয়সা, স্বর্ণলস্কার ও অন্যান্য নিয়ে আমাদের গ্রামে আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। গ্রামের কিছু মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন কারি দালাল। পাকিস্তানি অন্যান্য দালাল ও সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের গ্রামের পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে এসেছিল।বেড়া থানার পাকি দালাল আসাদা। বেড়া ক্যাম্প থেকে পাঁচ শতাধিক সৈন্য কে পথ দেখিয়ে লঞ্চে ডেমড়া নিয়ে এসেছিল। পরে জানলাম-শেষ রাতে আর্মিরা এসে ডেমরা, রুপসী ( বাউস গাড়ী) গ্রাম ঘিরে ফেলে ছিল। আযানের পর ওরা ডেমরা নদীর ঘাটের কাছে ব্রাশ ফায়ার করলো। গুলির শব্দে আমরা আত্ম রক্ষার জন্য রুপসী (বাউস গাড়ী) গ্রামের জঙ্গলের দিকে পালাতে থাকলাম। ফর্সা হওয়ার সাথে সাথে পাখির মত নির্বিচারে গুলি করে ওরা হত্যা করতে লাগলো। গ্রাামের কিছু ইসলামী রাজনীতির সমর্থক ওদের দালাল হলো। পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্দেশে হিন্দুর বাড়িঘর লুটপাট করলো। পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে হিন্দুদের বাড়িঘর চিনিয়ে দিল। হিন্দু নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে চিনিয়ে দিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ধরে আনলো।
পাকিস্তানি সৈন্যরা বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে। লাইনে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। গুলি খেয়ে যাঁদের মৃত্যু না হয় তাঁদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। রূপসী (বাউস গাড়ী) গ্রামের বলারাম রায়ের বাড়ীতে পেট্রোল তেলে সব ঘরে আগুন দেয়। তারপর হাত-পা বেধে জ¦লন্ত আগুনের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে গুলি করে হত্যা করে ঐ বাড়ির ৩ জন কে। জামিনী মোহনা পালকে রক্ষা করতে গিয়ে নির্মমতার শিকার হণ তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী কালিমতি পাল। পাকিস্তানি আর্মিরা নিলা ও শীলা নামের সুন্দরী যুবতী দুই বোন কে বেড়া ক্যাম্পে ধরে নিয়ে পর্যায় ক্রমে ধর্ষণ করে হত্যা করে। ডেমড়া বাজারস্থ কালী মন্দিরে প্রতিমাকে ব্রাশ ফায়ার করে ভেঙ্গেফেলে এবং মন্দিরে আগুন দেয়।ডেমড়া বাজারের সকল হিন্দুর দোকান লুট পাট করে আগুন দেয়। দুপুর ১২.০০ টা পর্যন্ত তারা ভয়াবহ তান্ডব চালায়। ১ টার পর পাকিস্তানি হানাদারদের চলে যাবার সংবাদ পেয়ে আমরা সবাই খুজতে থাকি। লাশের পর লাশ। কিছু লাশ ওরা মজাকুপের মধ্যে ফেলে দিয়ে ছিল। উত্তরাধিরা লাশ খুঁজে কিছু লাশ পাশের গোরস্থানের কবর দেন। হিন্দুদের লাশ মুখাগ্নি করে বড়াল নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিছু লাশ গণ কবর দেওয়া হয়। কিছু লাশ মাচি চাপা দেওয়া হয়। মানুষ যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। সারা সময় গ্রামের যে সকল দালালরা সহযোগিতা করে ছিল যাবার সময়দ পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের মধ্য থেকে কয়েক জন কে নির্মম ভাবে গুলি করে হত্যা করে ছিল।
লেখক :বীর মুক্তিযোদ্ধা,শাহজাদপুর,সিরাজগহঞ্জ।