গণদখলে বোয়ালমারীর গণকবর, হুমকির মুখে স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্ন
কাজী হাসান ফিরোজ, বোয়ালমারী : ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌর শহরতলীর সররকারি কলেজ সংলগ্ন গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলার শেষ পেরেকটা ঠুকতে গণকবরকে পিছে ফেলে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। এ কাজটা সম্পূর্ণ হলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের সম্মান ভূলুন্ঠিত হবে, সেই সাথে বর্তমান সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকাও হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
জানা যায়, '৭১এ স্বাধীনতা যুদ্ধোকালীন পাকিস্তানী ও তাদের দোসর রাজাকার আল বদর বাহিনী ছাত্রনেতা রেজাউলসহ শতাধিক মুক্তিকামী বাঙালি নারী-পুরুষকে হত্যাকরে সরকারি কলেজ সংলগ্ন ছনের ক্ষেতে মাটি চাপা দিয়ে রাখে।
প্রত্যক্ষ দর্শীদের থেকে জানা যায়, বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সটি ছিলো পাকিস্তানি বাহিণী ও তাদের দোসরদের টর্চার ও বিনোদন সেল। মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে ধরে এনে টর্চার সেলে নির্যাতনের পর হত্যা করে পার্শ্ববর্তী বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দেয়া হতো। নারীদের এনে নাচ গান করানো হতো। অতঃপর যৌন নির্যাতনের পর হত্যা করে ছনক্ষেতে ফেলা দেয়া হতো। কলেজ সংলগ্ন সবটুকু জমিই ছিলো বধ্যভূমি।
বধ্যভূমির নামে সামান্য একটু জায়গা সংরক্ষণ করা হয়েছিলো, তাও এখোন হুমকির মুখে। বধ্যভূমির উপর মালিকানা শর্তে বসতবাড়ি এবং শৌচাগার নির্মাণ করেছে এক জামাত নেতা। বাড়ি নির্মানের সময় খননকাজে শহীদদের অস্থিকঙ্কাল উঠে এলে বসতবাড়ির পাশেই তা পুনরায় সমাধিস্থ করে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। পরবর্তীতে সেখানে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার, সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুর রহমানের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
২০২০ সালে জনাব আব্দুর রহমান এর পরামর্শে উপজেলা প্রশাসন বোয়ালমারী পৌরসভার শিবপুর মৌজার ১২২৭ নং দাগের ৪৭ শতাংশ জমি অধিগ্রহণকরে গণকবরটি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের জন্য প্রস্তাবনা পাঠায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, দুই বছর আগে প্রস্তাবনা পাঠানো হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
গণকবরটি ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তিতে হওয়ায় সরু একটি সড়ক ও ৪/৫ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিয়ে সম্প্রতি উপজেলার রূপাপাত ইউনিয়নের কাটাগড় গ্রামের জনৈক মো. খালিদ হাসান বহুতল ভবন নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরগুরুত্বপূর্ণ অংশ মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকেই।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে গণকবরের জায়গাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। খুব শীঘ্রই সর্বজন স্বীকৃত একটি কমিটি গঠন করবো। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় রাজনীতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে সীদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বর্তমানে ওই জায়গায় কনেস্ট্রাকশনের কাজ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ২০২০ সালে গণকবরের জন্য ৪৭ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে, যাতে স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে ১৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের সুপারিশ করেছে। এ ব্যপারে সর্বজন স্বীকৃত একটি কমিটি গঠন করা হবে এ কমিটি যে ভাবে সুপারিশ করবে আমরা সে মত কাজ করবো। এলাকার স্বাধীনতার স্বপক্ষের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিগণ সংশোধিত প্রস্তাবনার বিরোধিতা করে বলেন ৪৭ শতাংশ জমিই অধিগ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সম্মানে পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিসৌধ ও কমপ্লেক্স গড়ে তোলার দাবি জানান।
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষক গাজী শামসুজ্জামান খোকন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বোয়ালমারীতে যে নারকীয় গণহত্যার সংঘটিত হয়েছিলো, তার স্বাক্ষর কলেজরোডস্থ এই গণকবর বা বধ্যভূমি। যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে এ গণকবরটি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। ইতোপূর্বে মূল গণকবরের উপর বসতবাড়ি, গণকবর ঘেঁষে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে, যা লজ্জাজনক। বাড়ি নির্মানের সময় খননকাজে উঠে আসা শহীদদের হাড় কঙ্কাল পুনরায় মুক্তিযোদ্ধারা সমাধিস্থ করে যেখানে গণকবরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে, বহুতল ভবন নির্মানের ফলে সেটিরও সংকোচন হলে শহীদদের বীরত্বগাঁথার ইতিহাস মুছে যাবে। স্বাধীনতার স্মৃতি রক্ষার স্বার্থেই এটা সংরক্ষণের জোর দাবি জানাই।
(কেএফ/এসপি/মে ১২, ২০২২)