‘এটমিক এনার্জি মানবজাতির টেকসই উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে’
রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র রিয়াক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র প্রথম ইউনিটে স্থাপন উপল্ক্ষে গত ১০ অক্টোবর বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার পরমাণু শক্তি সংস্থা রসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ। অনুষ্ঠানের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাইট অফিসে রসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের ঈশ্বরদী প্রতিনিধি স্বপন কুমার কুন্ডু।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্র্রকল্পটি বর্তমানে অত্যন্ত সরগরম ও উদ্দীপনাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আজকের দিনটি এই প্রকল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন- প্রথম ইউনিটের ডিজাইন পজিশনে স্থাপিত হয়েছে রিয়্যকটর প্রেসার ভেসেল। এর অর্থ হলো রিয়্যাক্টরে বর্তমানে অবস্থান করছে 'পরমানু হৃৎপিন্ড'। আমরা কোন সাধারণ নির্মান প্রকল্পের কথা বলছিনা, আমরা আলোচনা করছি একটি পারমানবিক প্রকল্প নিয়ে। এরপর শুরু হবে ১ম ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে রক্ত সঞ্চালনের জন্য রক্তনালী ব্যবস্থার নির্মান কাজ- যেমন বাষ্প জেনারেটর ইনস্টনেশন এবং মূল সঞ্চালন পাইপলাইনের ইন্সটলেশন।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি এখন এমন এক পর্যায়ে এসেছে যখন উচ্চপ্রযুক্তির ইন্সটলেশন কাজগুলো করা হবে। দ্বিতীয় ইউনিটের রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল ইতোমধ্যে সাইটে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় ইউনিটের বাস্তবায়নের মেয়াদ হ্রাস পাবে বলে আশা করছি। নির্মানে দীর্ঘসময় প্রয়োজন হয় এমন সকল যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ বলতে গেলে ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে অথবা পরিবহন পথে রয়েছে অথবা সাইটে ডেলিভারীর অপেক্ষা করছে। আশা করি মাসখানেক পর পথম ইউনিটের টার্বাইন এবং বৃহৎ যন্ত্রপাতিগুলো সাইটে পৌছে যাবে। আমরা ভাবছি দুই ইউনিট চালুর মধ্যবর্তী সময় কীভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব, যাতে এই সময়টা ১বছর না হয়ে, কিছুটা কমে আস। এর জন্য বড় ধরণের মোবিলাইজেশন দরকার হবে। এজন্য রুশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট এবং আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুদের আরো বেশি শক্তি নিয়োগ করতে হবে।
উল্লেখ্য, এই অভূতপূর্ব প্রকল্পটিতে বর্তমানে কাজ করছে ২০টি সাব কন্ট্রাকটর প্রতিষ্ঠানের ২৮,০০০কর্মী। ২০টি সাব-কন্ট্রাক্টরের মধ্যে ১১টি রাশিয়ার, বাকীগুলো বাংলাদেশী ও ভারতীয়। এখন এটা সত্যিই একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প। পরমানু শক্তির মতো একটি স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে উন্মুক্ত ও পারস্পারিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে সহযোগিতার একটি উদাহরণ এই প্রকল্পটি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছি এবং বাংলাদেশ ও রাশিয়া যে ধরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে আমি নিশ্চিত যে এই প্রকল্পে আমরা বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবো।
পরমানূ শক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন এই প্রশ্নের উত্তরে লিখাচভ বলেন, আমরা শুধু ভেবেই থেমে থাকিনি, রাশিয়া ও বাইরের দেশ গুলোতে আমরা আমাদেও বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কওে চলেছি। গত বছর রাশিয়ায় আমরা একটি মনস্তাত্তিক বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাশিয়ার ইতিহাসে আমরা প্রথমবারের মতো উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ২০ শতাংশের বেশী এসেছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। পারমানবিক বিদ্যুৎ একটি নির্মল, শান্তিপূর্ণ ও গ্রীন এনার্জি। আমরা রাশিয়ায় পারমাণবিক বিদ্যুতের শেয়ার ২৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এর জন্য যে সকল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জীবনকাল উত্তীর্ন হয়েছে সেগুলোর প্রতিস্থাপনই শুধু নয় বরং আরো অনেক নতুন পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান করতে হবে। অনেকেই আমাদের এই ভাবনার সঙ্গে একমত, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো, যার মধ্যে বাংলাদেশেও রযেছে। গত দশকে বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি সত্যিই অভূতপূর্ব। ভারত ও চীন স্বক্রিয়ভাবে পারমানবিক বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করছে। মিশর ও তুরস্ক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়েনে অন্তর্ভুক্ত অনেক দেশ নতুন পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান এবং পুরনোগুলোর আধুনিকয়ান অব্যাহত রেখেছে। বড় আকারের পারমাণবিক বিদ্যুৎ ইউনিট ছাড়াও ছোট ইউনিটের নির্মান নিয়েও তারা পরিকল্পনা করছে। যারা অন্যপথে হাঁটছে, ঐসব দেশগুলোতে এনার্জি ব্যালেন্সের ক্ষেত্রে কী ঘটছে তা সত্যিই ইন্ট্রেসটিং! এসব দেশগুলো পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসার পর গ্রীন এনার্জির পরিমান যে খুব বেশী রেড়েছে তা নয়। অধিকাংশ দেশেই এনার্জির মূল উৎস কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেগুলো পারমানবিক বিদ্যুকেন্দ্রের তুলনায় ৭০গুন বেশী কার্বন-ডাই-অক্সাইড নি:সরণ করে।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এসব দেশগুলোতে বিদ্যুতের ট্যারিফ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৫-৭ বছরে এই বৃদ্ধিও হার অনেকগুন (১০ বা কোন কোন ক্ষেত্রে ১০০ গুন)। আমরা এই ট্যারিফ শুধুমাত্র স্থিতিশীলই রাখতে সমর্থ হয়েছি তা নয়, বর্তমানে এমন প্রকল্প নকশা করছি যেখানে দশ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ মূল্য অপরিবর্তিত থাকার নিশ্চয়তা মিলবে। আমাদের কাছে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু নির্মল, সবুজ ও কম কার্বন নিঃসরণকারী বিদ্যুৎ উৎসই নয়, বরং এগুলোতে পরবর্তী ১০০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুতের গড়মূল্য ও বিদ্যুৎকেন্দ্র সার্ভিসিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় স¤পর্কে ধারনা পাওয়া সম্ভব। আমাদের এই ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থা, যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দুই শতাধীক দেশ। সংস্থাটির সর্বশেষ সম্মেলনে আমরা এই মর্মে একমত হয়েছি যে ইউরোপীয় কমিশন ও জাতিসংঘে আমাদের এই মতাদর্শ প্রচারের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো হবে। শান্তিপূর্ন ও গ্রীন এটম ও এটমিক এনার্জি মানবজাতির টেকসই উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে করোনা অতিমারী ব্যাবস্থাপনা সম্পর্কে রসাটম মহাপরিচালক জানান, এটা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে প্রকল্পটির নির্মানকাজ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা এমন এক সময় করতে হচ্ছে যখন আধুনিক বিশ্ব অত্যন্ত ভয়াবহ এক অতিমারীর সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ায় যে সকল বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে, তা আমরা নির্মানকাজের সঙ্গে জড়িত সকলেই নিঃশর্তভাবে পালন করছি। আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো গত দেড় বছরে আমাদের প্রকল্পগুলোতে অতিমারীর বড় ধরণের সংক্রমন রোধ করতে সমর্থ হয়েছি এবং গুরুতর আক্রান্তদের সংখ্যা ছিল নূন্যতম। নিজেদের সুরক্ষার জন্য আমরা অতি প্রয়োজনীয় সকল নিয়মকানুন বিশেষভাবে অনুসরণ করেছি, বর্তমানেও করছি এবং ভবিষ্যতেও করবো। জনগনের সুরক্ষা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানকাজের চেয়ে কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
রূপপুর প্রকল্পে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে ৯০% রুশ কর্মীদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছি। রুশ সরকার বাংলাদেশী কর্মীদের ভ্যাকসিন সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং খুব শীঘ্রই কয়েক হাজার ডোজ ভ্যাকসিন প্রকল্প সাইটে এসে পৌঁছবে। বিভিন্ন মেডিক্যাল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা অত্যন্ত ভালো এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছি। এ প্রসঙ্গে আমি বাংলাদেশ সরকার ও স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়কে ধন্যবাদ জানাতে চাই। রূপপুর প্রকল্পে শুধুমাত্র একজন গুরুতরভাবে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন, যাকে চিকিৎসার জন্য মস্কো নিয়ে যেতে হয়েছে। অন্যান্য সকলের চিকিৎসা স্থানীয়ভাবেই করা হয়েছে। যদিও রাশিয়ায় অতিমারীর নতুন ওয়েভ পরিলক্ষিত হচ্ছে, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বাংলাদেশে আমাদের কাজ পুর্নদ্যোমে এগিয়ে চলেছে। আমি দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছি যে প্রকল্প সাইটে সকলেই যথাযতভাবে সকল বিধিনিষেধ মেনে চলছেন। এজন্য আমি সকল বাংলাদেশী ও রুশ সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
(এসকেকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২২)